সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও বাঙালির আন্দোলন

আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

সাতচল্লিশে দেশভাগের এক বছরের মধ্যেই বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনে নেমেছিলো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিলো। তারা চেয়েছিলো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির উপর চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলো বাঙালি; একাত্ম হয়ে লড়াই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ এবং পরবর্তীতে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন তিনি।

বাঙালি জাতির প্রকৃত ভিত্তিসূত্র ‘বাংলা’ভাষা। অমর ‘একুশ-এর সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা এবং বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করার শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিকভাবে বাংলা যেমন শোষিত শ্রেণির ভাষা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনও আজীবন শোষিত শ্রেণির মুক্তির জন্য লড়াই করা।

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এমনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে একটি ছেড়ে অন্যটি কল্পনাতেও আসে না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ও বাঙালি জাতীয়তার চেতনাকে ধ্বংস করার নীল নকশার অংশ হিসেবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে বাংলার জনগণের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেন।

ভাষা, সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অমিল থাকার পরও কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২শ’মাইল ব্যবধানের দু’টি পৃথক ভূখন্ডকে এক করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সমগ্র পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা; অন্যদিকে ৭.২ শতাংশ মানুষ কথা বলতো উর্দুতে। সেই উর্দুকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাঁয়তারা শুরু করে। কিন্তু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা হতে দেয়নি।

কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল কোলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে। সে বৈঠকে আলোচ্য বিষয় ছিলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের যুবসমাজের করণীয় কী? এর কয়েকদিন আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’।

এর দাঁতভাঙা জবাবে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি রাষ্ট্রভাষা হয় তবে গণতন্ত্রসম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। একাধিক রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে’ (বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন, এম আবদুল আলীম, পৃষ্ঠা-৭৫)।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তখনকার প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার ধারক যুব-সম্প্রদায়কে। বৈঠকের নেতৃবৃন্দ ঢাকা পৌঁছালেন, ঢাকার ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন আহŸান করা হলো। জন্ম নিলো পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিন্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’ (‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গাজীউল হক, ভাষাসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা-৯)।

এভাবেই ভাষার দাবি সেদিন বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষা বীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ ২১-দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ঐ ইশতেহারে ২১-দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ছাত্রলীগের ১০-দফা দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগ ও স্বাক্ষরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নামে ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। এই লিফলেট সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলা হয়েছে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে তাঁকে প্রকাশ্যভাবে ধিক্কার জানান লিয়াকত আলী খান। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তমিজউদ্দিন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার রিরোধিতা করেন। নাজিমুদ্দিন বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়’।

২৬ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘটে শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকা রাখেন। মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে আসল। কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল।.. ..

আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। ঢাকার জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৯৩)।

‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০ টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়’ (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-২০৬)

১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে     ৮-দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেওয়া হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিব চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষা সৈনিকরা কারামুক্ত হন।

১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যায়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিশ ছাত্রলীগের আহ্বানে নইমউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায়ও শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন।

ঐদিন দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলা মায়ের মাটি যেন প্রকম্পিত হতে লাগলো। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর নেতৃত্বে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদ করেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৯৯)।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন। ১৬ ফেব্রæয়ারি জেলে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরণের নিপীড়ন অবসানের দাবিতে অনশন শুরু করেন। ঢাকা কারাগারে তাঁর সঙ্গে ঢাকার ছাত্রদের যেন কোনো যোগাযোগ না হয় সেজন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

ক্তিগতভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে।…

আমি  ওদের রাত একটার পর আসতে বললাম।…দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত।…বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।…সেখাইেন ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে’(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৭)।

২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন দমনে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। রাত ভর বিভিন্ন হল ও ছাত্রাবাসে চলে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতিমূলক সভা। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আব্দুল আউয়াল, আব্দুস সালাম, ওলিউল্লাহ (মতান্তরে ওহিউল্লাহ) প্রমুখ এবং বহু নেতা পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন।

প্রতিবাদে সারা বাংলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

তিনি বলেন, ‘আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে- হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন’ (বাংলাদেশ: প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১১৭)।

ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১-দফার প্রথম দফা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন।

তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিশ’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে জয়পুরহাটে আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে আওয়ামীলীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুপারিশ করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ তার ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগে পরিনত হলো।

২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘..ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটির একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য..’(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-২৯৩)।

১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে’।

পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হোক’। ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আইনসভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স-এর সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’র ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাদের আশ্বাস দিচ্ছি, কবি এবং সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের জন্য যেকোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে’।

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে ফেব্রæয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা একাডেমি যে সপ্তাহ পালন করছে সে সপ্তাহ বাংলাদেশের জীবনে এক কঠিন সপ্তাহ।

ফেব্রুয়ারির এই দিনেই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, এই সপ্তাহেই কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হককে, এই সপ্তাহেই শহীদ হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা, আর এই সপ্তাহেই কারফিউ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে আত্মাহুতি দিয়েছে এ দেশের অসংখ্য মায়ের অসংখ্য নাম না জানা সন্তান।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে’(বাংলাদেশ: প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-৪৫২)।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। যে সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বিশ্ব সভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেননি। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৫১-তম অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দেন। এরপর থেকে তিনি প্রতি বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে আসছেন। ভাষা শহিদদের স্মৃতি চির স্মরণীয় করে রাখতে তিনি ২০১০ সালে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের দ্বিতীয় তলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর (খধহমঁধমব গড়াবসবহঃ গঁংবঁস) উদ্বোধন করেন।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনসকো ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে বাংলার মানুষ আজ অর্জন করছে স্বাধীন-সার্বভোম বাংলাদেশ। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকোর ঐতিহাসিক দলিলের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২১ ফেব্রæয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রে পালিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুয়ের প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা মাধ্যম হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।

পৃথিবীর বহু দেশে এ ভাষার অনুশীলন হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তিতেও বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। এখন বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে নান রকম অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস্। এসব অ্যাপস্ স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট কম্পিউটারে সহজেই ব্যবহার করা যায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বাংলা ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তাঁর মতো এমন মহানায়ক আর কে আছেন বাংলায়! ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।

জয় বাংলা’ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, তথ্য মন্ত্রণালয়, পৃষ্ঠা-২০)। তাইতো বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও বাঙালির আন্দোলন- অবিচ্ছেদ্য।

লেখক:

উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক)

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ

সম্পর্কিত পোস্ট