সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
পাকিস্তানে আজ ১৬তম পার্লামেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। আজ সকাল থেকে পাকিস্তানের ৪ প্রদেশ ও ৩ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে একযোগে শুরু হবে ভোটগ্রহণ। ভোটের আগের দিন বুধবার বেলুচিস্তান প্রদেশে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির ইংরেজি ভাষার দৈনিক ডন।
নির্বাচনের দুদিন আগে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ও প্রার্থীদের বাড়িতে গ্রেনেড হামলাও চালানো হয়েছে। এদিকে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইমরানকে জেলে ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে দিশাহীন পাকিস্তানে যে নির্বাচন হচ্ছে; তা সংকট উত্তোরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না।
বুধবার প্রথম হামলাটি হয় বেলুচিস্তান প্রদেশের পিশিন জেলায় একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কার্যালয়ের কাছে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয় আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী কিল্লা সাইফুল্লাহ শহরে প্রাদেশিক রাজনৈতিক দল জামিয়াত উলেমা ইসলামের (জেইউআই) একটি কার্যালয়ের কাছে। এ ঘটনা আজকের ভোটের দিনের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক মাসে পাকিস্তানজুড়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে।
প্রথম হামলায় ১৪ জন নিহত এবং প্রায় ৩০ জন আহত হন বলে জানান পিশিন জেলার ডেপুটি কমিশনার জুম্মা দাদ খান। পরে আহতদের মধ্যে আরও ৪ জনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়। এই ১৮ জনের সঙ্গে কিল্লা সাইফুল্লাহর বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শহরের ডেপুটি কমিশনার ইয়াসির বাজারি। এখন পর্যন্ত দুটি হামলার দায় কেউ স্বীকার করেনি।
ভোটের ঠিক আগের দিন পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণে এত মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক কাকার বলেন, তার সরকার শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন ঘিরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যস্ত করার সব ধরনের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন এবং পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
ভোটকেন্দ্র ও প্রার্থীদের বাড়িতে গ্রেনেড হামলা : পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কয়েকজন মোটরসাইকেল আরোহী কোয়েটার কিল্লি আহমেদজাই এলাকার একটি সরকারি স্কুলে হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়ে। গ্রেনেডটি স্কুল প্রাঙ্গণে বিস্ফোরিত হয় এবং এতে ভবনের জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই স্কুলটি কাল (বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত একটি ভোটকেন্দ্র।
পাসনি এলাকার একটি সরকারি স্কুল প্রাঙ্গণ থেকেও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল বিস্ফোরকটি নিষ্ক্রিয় করেছে। কেচ জেলার হোশাব এলাকায় জাতীয় ডাটাবেজ ও নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের একটি কার্যালয়েও গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এতে ভবনের জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে জাতীয় পরিষদে আওয়ারান এলাকা থেকে বিএনপি-মেঙ্গলের প্রার্থী মির মোহাম্মদ ইয়াকুবের বাড়িতে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। বুলেদাতে পিএমএল-এনের প্রার্থী মির মোহাম্মদ আসলাম বুলেদির বাড়িতেও হামলা হয়েছে। আর পাঞ্জগুর শহরে দুটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। ন্যাশনাল পার্টির নেতা আবদুল কাদের সাজদি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী নুর বালুচের বাড়ি লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়। তবে এ দুই নেতা অক্ষত আছেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রার্থী আগা গুলের বাড়িতেও গ্রেনেড হামলা হয়েছে। বিস্ফোরণ হয়েছে কেচ জেলার তুম্প এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি চৌকির কাছেও। তবে এতে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
তবুও ভোট, মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান-নওয়াজ : ৮ লাখ ৮১ হাজার ৯১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ২৪ কোটি ১০ লাখ। ইসিপির নথি অনুযায়ী, মোট এই জনসংখ্যার মধ্যে ভোটারের সংখ্যা অর্ধেকের কিছু বেশি ১২ কোটি ৮০ লাখ। তাদের একটি বিশাল অংশ আজ ভোট দেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী পাকিস্তান গত কয়েক বছর ধরে রয়েছে ভয়াবহ অর্থসংকটে। ডলারের বিপরীতে রুপির টানা অবনমন, বিদ্যুৎ সংকট, বেকারত্ব, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ জনগণের।
বিগত কয়েক দশকজুড়ে জঙ্গি তৎপরতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করছে পাকিস্তান। প্রায় দু’দশক আগে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে দেশটি। তারপরও করোনা মহামারির পর থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার হিড়িক পড়েছে। পাকিস্তানের সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, শুধু ২০২৩ সালে সন্ত্রাসীদের বোমা ও বন্দুক হামলায় যত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা গত এক দশকের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
চারটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের : ভারত, আফগানিস্তান, ইরান এবং চীন। গত কয়েক বছরে এক চীন ব্যতীত অন্য তিনটি দেশের সঙ্গে তিক্ততা বেড়েছে ইসলামাবাদের। শিগগির সেই তিক্ততা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। রয়টার্স বলছে, এসব কারণে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানে উত্তেজনা-উৎসবমুখর পরিবেশ থাকার কথা ছিল, স্বাভাবিকভাবেই তা অনেকটা ফিকে। দেশটির শীর্ষ জাতীয় দৈনিক ডন বুধবার তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ইস্যুতে প্রধান ৩টি দলের কোনোটিই এখন পর্যন্ত কোনো দিশা দেখাতে পারেনি। সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সমস্যার কথা বলছে, কিন্তু কোনো দলের নির্বাচনি ইশতেহারে এটি পরিলক্ষিত হয়নি যে কীভাবে এসব সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক সংস্থা ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের জ্যেষ্ঠ গবেষক আসফানদিয়ার মির রয়টার্সকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ইরান ও আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকাগুলোতে ঘন ঘন অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে। এই সংকট কাটানোর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি; কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে এ ইস্যুতে কিছু দেখা যায়নি।’
কিন্তু এই দিশাহীন পরিস্থিতির মধ্যেও একটি চাপা উত্তেজনা কাজ করছে পাকিস্তানজুড়ে। আর সেই উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছেন দেশটির দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং ইমরান খান।
জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) পার্টি এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোটের প্রধান হিসেবে ধর্মীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে মাওলানা ফজলুর রহমানের। তার রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত বরাবরই পিটিআই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কঠোর বিরোধিতার ইতিহাস। যে বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বে পিডিএম জোট গঠন হয়। জোটের ঐক্যবদ্ধ ও জোরালো আন্দোলন ২০২২ সালের এপ্রিলে খানের সরকার উৎখাতে সফল হয়।
সেই সুবাদে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) বা পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) যে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাক, বিশ্লেষকদের কারও কারও ধারণা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন জমিয়ত উলামা-ই-ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান।
প্রচ্ছন্ন সেনা হস্তক্ষেপ : সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর পর আস্থা ভোটে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন ইমরান খান। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ রয়েছে, তাকে সেনাবাহিনীই ক্ষমতায় এনেছিল। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রিত্ব খুইয়ে জেলে যেতে হয়েছে ইমরানকে। তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। তাদের দলীয় প্রতীকও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যে কারণে পিটিআই প্রার্থীরা এখন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে লড়ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সবসময়ই নির্বাচনে কমবেশি ভূমিকা রেখেছে। তবে এবারের নির্বাচনে তারা নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ করছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হুসেইন নাদিম সিএনএনকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগের পরিবেশ অস্থিতিশীল, গভীরভাবে মেরুকৃত এবং রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অবিশ্বাসে ভরা।
একসময় দুর্নীতির দায়ে রাজনীতিতে আজীবন নিষেধাজ্ঞার দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত নওয়াজ শরিফ লন্ডন ও দুবাইয়ে চার বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরেছেন। নির্বাচনি নিষেধাজ্ঞা কাটাতে সক্ষম হয়েছেন এবং এবারের নির্বাচনে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি আসন থেকে নির্বাচন করছেন। আর তিনি দেশে ফেরার কয়েক মাস আগে কারাগারে গেছেন ইমরান খান। রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস (সাইফার) এবং তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে যথাক্রমে ১০ ও ১৪ বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। এই নির্বাচন করতে পারছেন না তিনি। তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) যেসব প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদেরকে দলের নির্বাচনি প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন ও আদালত। ফলে নিজেদের বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রার্থীদের তুলনায় বেশ বেকায়দায় আছেন পিটিআই প্রার্থীরা।
তারপরও নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানে যতখানি উত্তেজনা রয়েছে; তার মূল অবদান নওয়াজ ও ইমরানের দলের। এবং অসম হলেও প্রকৃত লড়াই হচ্ছে পিএমএলএন এবং পিটিআইয়ের প্রার্থীদের মধ্যে। একদিকে পিএমএলএন পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং অন্যদিকে পিটিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইমরান খান পাকিস্তানের শীর্ষ জনপ্রিয় নেতা।
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে ওয়াশিংটনের হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক হুসাইন হাক্কানি বলেন, ‘এই নির্বাচন থেকে আসলে ভবিষ্যতের কোনো দিশা পাওয়ার আশা খুবই ক্ষীণ। কারণ নামে নির্বাচন হলেও এটি আসলে দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যকার লড়াই।
কারাগার থেকে ইমরানের বার্তা : নির্বাচনকে সামনে রেখে কারাগার থেকে ভোটারদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ইমরান খান। নিজেদের অধিকার রক্ষা ও পোলিং স্টেশন পাহারা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক এক্স বার্তায় (সাবেক টুইটার) তিনি ভোটারদের কাছে এই আহ্বান জানান। তার এই বার্তা দলের পক্ষ থেকেও শেয়ার করা হয়েছে।

সম্পর্কিত পোস্ট