সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ থাকছে না

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন দায়িত্বে থাকবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার বিধান থাকলেও সরকারের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদের কথা উল্লেখ নেই।
সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ হচ্ছে একটি সরকার থেকে নতুন আরেকটি সরকার গঠন হওয়া পর্যন্ত। তা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো রূপরেখাও নেই। তাই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন আইনবিদরা।
তারা বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে সংবিধানের বাইরে গিয়ে এ সরকার গঠন করতে হয়েছে। এ কারণে এ সরকার কতদিন দায়িত্ব পালন করবে তা দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কবে নাগাদ নির্বাচন করা সম্ভব হবে তার ওপর নির্ভর করছে।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তবে কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটি করা না গেলে নির্বাচন করতে হবে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে ৬ আগস্ট। তাই সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৪ নভেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
আর সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কারণ সংবিধানের ১১৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন, (খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবেন এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন। (২) উপরিউক্ত দফাসমূহে নির্ধারিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে, নির্বাচন কমিশন সেরূপ দায়িত্ব পালন করবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো রূপরেখা না থাকায় বর্তমান এ সরকারের মেয়াদ আসলে কতদিন হবে, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেরাই নির্ধারণ করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর নির্বাচিত এক সরকার থেকে আরেক সরকারে যাওয়ার বিধান রয়েছে সংবিধানে। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ করলেও পরবর্তী সরকারপ্রধান নিয়োগ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ায় সেই সুযোগ নেই।
অন্যদিকে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারবিহীন বর্তমান অবস্থাকে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ কারণে সংবিধানের বাইরে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। গত সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় বলে মত দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত সংসদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়সীমা তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সেনাশাসক এইচএম এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাকে সরকারের প্রধান করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ওই সময়ে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে সে পদে বসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর সাহাবুদ্দীন আহমদ অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হন। পরের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে এই মেয়াদের বৈধতা দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শপথ নেওয়া ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় দুই বছর। এই বাড়তি মেয়াদও পরে সংবিধানে বৈধতা দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এখানে দুটো জিনিস দেখতে হবে। একটি হলো সংবিধান, অন্যটি হলো গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন না। সংবিধানের কোথাও গণঅভ্যুত্থান নেই। সংবিধানে এ রকম কিছু নেই। তবে গণঅভ্যুত্থানে যারা জয়লাভ করে, তাদের ইচ্ছামতোই সবকিছু হবে। যে ইচ্ছা তারা করবে, সেটি আইনে যাওয়ার সুযোগ আছে। তবে বলা যাবে না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে করলাম। গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ীরা করতে পারেন, সেটি পরে আইনে রেক্টিফাই করতে হবে। সেটি সংবিধান অনুযায়ী ফর্ম করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল বলেন, সংসদ বিলুপ্তির পর রাষ্ট্রপতিই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। নির্বাহী ক্ষমতাবলেই তিনি নতুন উপদেষ্টা পরিষদের মেয়াদ বেঁধে দিতে পারেন অথবা সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন।
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘যদি কোনও সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। পুলিশসহ অন্য বিভাগগুলো গড়তে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ছে। এগুলো গড়ে তুলতে অবশ্যই সময় প্রয়োজন। রাজনৈতিক সরকারের হাতে এসব কাজ ছেড়ে দিলে কোনোটাই বাস্তবায়িত হবে না। তাই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে এ মুহূর্তে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র : সময়ের আলো

সম্পর্কিত পোস্ট