প্রান্তিক খামারিদের কথা মাথায় রেখে সরকার মাংস আমদানি নিরুৎসাহীত করবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সচিবালয়ে নিজ দফতরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক জার্নালিস্ট ফোরামের (এফএলজেএফ) সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, কিছু অর্থলোভী ব্যবসায়ী ভারতীয় গরুর পাশাপাশি মাংস আমদানির পাঁয়তারা করছে। ওই চক্রের তৎপরতা থেমে নেই। প্রান্তিক খামারিদের বাঁচাতে সরকারিভাবে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে আমরা মাংস আমদানি করব না। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে মাংসের দাম কমানোর বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে এবার ভারতে কোনো ইলিশ মাছ যাবে না বলেও জানান তিনি।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, নতুন করে হিমায়িত গোমাংস আমদানির পক্ষে একটি পক্ষ তৎপরতা শুরু করেছে। আমরা কোনো মাংস আমদানি করতে চাচ্ছি না। এ দেশে এখন লাখ লাখ খামারি গবাদিপশু লালন-পালনের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে ২০-২৫ লাখ পশু অবিক্রিত থেকে যায়। এমন পরস্থিতিতে দাম বৃদ্ধির অজুহাত তুলে মাংস আমদানি করলে প্রথমে হয়ত কম দামে পাওয়া যাবে, কিন্তু মাংসের চাবিকাঠি চলে যেতে পারে অন্য দেশের কাছে। লাখ লাখ লোক গবাদিপশু পালন করছে। এই বাজারটা নষ্ট করে ফেললে আমাদের সমাজটা কোন অবস্থায় পড়বে এটাও চিন্তা করার বিষয়। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে মাংসের দাম কমানোর বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা সচেতন আছি জনগণ যাতে স্বল্প ও ন্যায্য মূল্যে মাংস খেতে পারে এবং খামারিরা টিকে থাকতে পারে।
হিমায়িত মাংসের পুষ্টিগুন নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফরিদা আখতার বলেন, বিদেশ থেকে এসব মাংস এসে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হতে পারে। ফলে এসব খাবারে নানা রোগ-ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পশু খাদ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, খামারিদের খরচ কমাতে পশু খাদ্যের দাম কমানো হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিলে কৃষি খাতের মতো ভর্তুকির বিষয়েও আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো। এই খাতের প্রান্তি চাষি ও উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হবে। উন্নত জাত লালন-পালনকে সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি দেশিয় জাতের পশু টিকিয়ে রাখতে করনীয় কি তাও নির্ধারণ করা হবে। এটা শুধু এককভাবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করবে না। এরসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িত। এই ভিত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে আমরা পদক্ষেপ নেব।
ভ্যাটেরিনারি হাসপাতালে মানুষ গবাদিপশুর চিকিৎসা সঠিকভাবে পায় না এবং প্রাণিসম্পদ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ফরিদা আখতার বলেন, জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। এই সরকারের সময় কেউ দুর্নীতি করলে পার পাবে না। তাই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবে না। কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতি বছর দুর্গাপূজায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ উপহার পাঠানো হয়। তবে এবার ভারতে কোনো ইলিশ যাবে না বলে জানান ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না। ফলে এবার দুর্গাপূজায়ও ভালতে যাতে কোনো ইলিশ না যায় তার জন্য আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি। অবৈধ পথেও যাতে কোনো ইলিশ যেতে না পারে সে বিষয়ে সীমান্ত এলাকায় কঠোর থাকতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছি। স্বল্প আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ইলিশ মাছের দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উপদেষ্টা।
সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কারণে পশু খাদ্য, মাংস-ডিমের দাম বেড়ে যায় জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সেই সাথে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে দাম কমে আসবে। এজন্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। পশু খাদ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে। এ ছাড়া পোলট্রি খাতে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে প্রান্তিক খামারিরা জিম্মি হয়ে আছে। মুরগি উৎপাদন করে বাজারে নায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। লাভ হচ্ছে সিন্ডিকেটকারীদের। আর নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ খামারিরা। পাশাপাশি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের নামে খামারিদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে। শিগগিরই এসব অনিয়মের লাগাম টানা হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা বিবেচনায় খাদ্যপণ্য ভেজালমুক্ত করা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং খামারিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন উপদেষ্টা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঋণের কিস্তি তিন মাস স্থগিত রাখার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমি বন্যা দুর্গত কুমিল্লা জেলা সরেজমিনে গিয়ে খামারিদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশুর আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের বিষয় আমরা ভাবছি।
সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনার খবর গণমাধ্যমে বেশি বেশি উঠে আসা দরকার। সমস্যাগুলো উঠে এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাণিসম্পদ খাতকে গণমাধ্যমে ভালোভাবে তুলে ধরলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মত বিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক জার্নালিস্টস ফোরামের (এফএলজেএফ) সভাপতি এম এ জলিল মুন্না রায়হান, সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বায়েজীদ মুন্সী, দপ্তর সম্পাদক বেলাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য কাওসার আজম, নাসির উদ্দিন ও গৌতম ঘোষ।