শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয় সংস্কার চায় ছাত্রসংগঠনগুলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দশ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজনীতি বন্ধ না করে সংস্কার করা এবং ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া ক্যাম্পাসে অন্যান্য বিষয়ও এ আলোচনায় উঠে এসেছে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনস্থ উপাচার্যের কার্যালয় সংলগ্ন লাউঞ্জে এ বৈঠক শুরু হয়। এতে দুই দফায় দশটি ছাত্রসংগঠন অংশ নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।
যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়
বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতা সময়ের আলোকে জানান, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে কিভাবে সংস্কার করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকল মতের অধিকার নিশ্চিত করা, সকল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা, দখলদারিত্ব ও পেশীশক্তির রাজনীতি বন্ধ করে সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি চালু রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস সময়ের আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের যে দীর্ঘদিনের রাজনীতির নামে হল দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিলো এগুলোই শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্র রাজনীতি মনে হয়েছে। আলোচনায় আমাদের দাবি ছিলো ছাত্র রাজনীতিকে বন্ধ না করে ছাত্র রাজনীতির একটি যৌক্তিক সংস্কার করে শিক্ষার্থীবান্ধব একটি রাজনীতি ক্যাম্পাসে চালু রাখা। আমরা বলেছি, মেধা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে যে শিক্ষার্থী হলে সিট পাওয়ার যোগ্য তাকেই যেন সিট প্রদান করা হয়।
তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এ বিষয়ে অফিসিয়াল কোনো বিজ্ঞপ্তি আসেনি।
আলোচনায় অংশ নেওয়া ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক আরমানুল হক সময়ের আলোকে বলেন, বৈঠকে ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্র রাজনীতির সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি কমিশন গঠন করা হবে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজনের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান কি প্রক্রিয়ায় হবে,ছাত্রসংগঠনগুলো কিভাবে কাজ করবে সেসব বিষয়ে ওই কমিশনের মাধ্যমেই সংস্কার করা হবে।
ছাত্র ফেডারেশনের এই নেতা সময়ের আলোকে আরও জানান, সিন্ডিকেট সভার বৈধতা নিয়েও আমরা প্রশ্ন তুলেছি। সিন্ডিকেট সভায় যে বারো-তেরো জন সদস্যের সাথে বৈঠক করা হয়েছে, তারা সবাই ফ্যাসিস্টের দোসর ও নীলদলের পদধারী ছিল। যেহেতু ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা হয়েছে তাই আমরা প্রশ্ন তুলেছি, কিভাবে তারা এ আলোচনা করতে পারে।
বৈঠক শেষে ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, আমরা শুধু আলোচনা করেছি। এখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ছাত্র শিবিরের পক্ষ থেকে আমাদের প্রস্তাব ছিল ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। আমরা রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই না, ইতিবাচক সংস্কারের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত থাকতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ পরিষদ ভেঙে দেওয়া এবং বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।
আলোচনায় উপস্থিত থাকা বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা সময়ের আলোকে বলেন, আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ কার্যকর করার দাবি জানানো হয় এবং দ্রুত মিটিং ডাকার আহবান জানানো হয়৷ এতে উপাচার্য স্যার ইতিবাচক মনোভাবে দেখিয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা একটি বামসংগঠনের শীর্ষ নেতা সময়ের আলোকে বলেন, একাত্তরের গণহত্যার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেমন শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তেমনি জুলাই গণহত্যার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয় কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে।
ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি ছাত্রসংগঠনগুলোর
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা সভায় ইসলামি ছাত্রশিবিরের উপস্থিতির বিষয়ে আপত্তি তুলেছে ছাত্রসংগঠনগুলো।
বৈঠকে উপস্থিত নেওয়া একাধিক ছাত্রসংগঠনের সভাপতি সময়ের আলোকে বলেন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ কনভেনশন অনুযায়ী ছাত্রশিবির ও ছাত্রসমাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেখানে আজ সেই চুক্তিকে অবজ্ঞা করা হলো। উপাচার্যের সাথে বৈঠকে ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে সকলে ছাত্রসংগঠন আপত্তি ও নিন্দা জানায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস সময়ের আলোকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় একটা নতুন প্রশাসন গঠিত হয়েছে, সকল কিছু আইন মেনে হয়েছে। আমরা যারা প্রগতিশীল -ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের মধ্যে একটা আলোচনা হতে পারত, শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হতে পারত। তাহলে পরিবেশ পরিষদ একটা আইন, সেই নিয়ম প্রথম দিনই কেন ভঙ্গ করা হল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে অবশ্যই আমরা মর্মাহত।
বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ছাত্রসংগঠনগুলো যেখানে কেউ জানতাম না ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কেউ অ্যাক্টিভ আছে কিনা, সেখানে উপাচার্য স্যার কিভাবে জানলো? কেননা এ বৈঠকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি আত্মপ্রকাশ করেছে,  তাহলে এর আগে উপাচার্য স্যার কিভাবে ছাত্রশিবিরের সভাপতির পরিচয় জানলো এ বিষয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি। তবে এ প্রশ্নটি উপাচার্য স্যার খুব সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়। সকল সংগঠন প্রতিবাদ জানালেও তিনি এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট কথা বলেননি।
যেসব ছাত্রসংগঠন উপস্থিত ছিল
এতে সকাল ১১টায় প্রথম দফার বৈঠকে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কাইয়ুম ও সাহিত্য সম্পাদক রেজাউল করিম শাকিল, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের আহ্বায়ক কমিটির সাজেদুল ইসলাম ও প্রজ্ঞা চৌধুরী, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আতিক চৌধুরী, নৃবিজ্ঞান বিভাগের নাইম উদ্দিন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আদনান আজিজ বৈঠকে অংশ নেন।
এরপর দুপুর ২টায় ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ  সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা শাখার সাপতি ইয়াছিন আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আহসান মারজান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা ও সাধারণ সম্পাদক সামি আব্দুল্লাহ; ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক, ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ; সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সাদিক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক; সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) এর বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সুহাইল আহমেদ শুভ প্রমুখ বৈঠকে অংশ নেন। এ দফায় বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এ বৈঠক চলছে।
এদিকে আলোচনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি না সে বিষয়ে আমাদের একটি অফিসিয়াল বক্তব্য আমাদের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের মাধ্যমে যাবে। আমাদের প্রধান চিন্তা এখন দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা। শ্রেণি কার্যক্রম চালু করা। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই সবাইকে ডেকে আলোচনা করলাম।

সম্পর্কিত পোস্ট