রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪

রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতা, পথে পথে ভোগান্তি

রাজধানীসহ সারা দেশেই গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কখনো ঝিরিঝিরি, তো কখনো মুষলধারে। অনবরত ঝরতে থাকা বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ালেও কোনো বিরতি নেই আশ্বিনের এই বৃষ্টিতে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টির কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, অলিগলি এবং ফুটপাতেও দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। কোনো মার্কেটের সামনে এবং সড়কে বৃষ্টির পানিতে থইথই অবস্থা দেখা গেছে। যে কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হয়। আবার শনিবার ছুটির দিন থাকলেও বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে দীর্ঘ যানজট। সব মিলিয়ে কাজের জন্য বের হওয়া রাজধানীবাসীর যেন ভোগান্তির শেষ ছিল না।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে ঝরতে থাকা বৃষ্টি সহসাই বন্ধ হচ্ছে না। বরং দেশজুড়ে আরও ২৪ ঘণ্টা বজ্রসহ ভারী বৃষ্টি এবং ঝড় অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর থেকে বৃষ্টির প্রবণতা কমে এলেও পরবর্তী ছয় দিন বৃষ্টি থাকবে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় চাঁদপুরে সর্বোচ্চ ২৭৭ মিলিমিটার এবং ঢাকায় ৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি উত্তর বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় আগের মতোই অবস্থান করছে। এর প্রভাবে সারা দেশেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে আজ রোববার থেকে সারা দেশে বৃষ্টিপাত কমতে পারে। তবে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে কয়েক দিনের মতো ভারী না হলেও এ মাসের ১২ তারিখ পর্যন্তই সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাত হবে। এরপর বৃষ্টিপাত কমতে পারে।
শনিবার টানা বৃষ্টির কারণে রাজধানীর পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, সচিবালয়ের সামনে আবদুল গণি রোড, প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা, সেগুনবাগিচা, নাইটিঙ্গেল মোড়, পল্টন, কাকরাইল, নয়াপল্টন, শান্তিনগর, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, মোহাম্মদপুর, ইসিবি, মালিবাগ, সায়েদাবাদ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেটের নতুন রাস্তায়, খামারবাড়ী থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, ধানমন্ডি, মিরপুর ১৩, শনিরআখড়ার সড়ক ও অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো এলাকার নিম্নাঞ্চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ডুবে যায় অনেক সড়ক। অফিস যাওয়ার পথে অনেককেই দোকানের ভেতরে, যাত্রী ছাউনিতে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক পানি জমায় চলার পথ হয়েছে সরু। অন্যদিকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় গণপরিবহন ‘ইচ্ছামতো চলাচল করতে গিয়ে’ তৈরি হয়েছে যানজটও। ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বহু মোটরসাইকেল চালককে। রেইনকোট পরে কেউ কেউ ঝুম বৃষ্টিতেই রওনা দিয়েছেন অফিসের উদ্দেশ্যে।
রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে কাকরাইল হয়ে শান্তিনগরের রাস্তায় প্রায় হাঁটু পানি জমেছে। এর মধ্যে যানবাহন চলাচলের কারণে সৃষ্ট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ফুটপাথ ও দোকানে। ওই রাস্তায় আসা পথচারী জাহিদুল ইসলাম বলেন, পুরো রাস্তায় হাঁটু পানি জমেছে। এর মধ্যে যখন যানবাহন চলাচল করছে সেই ঢেউ এসে আমাদের গায়ে আছড়ে পড়ছে। অনেক দোকানে পানি ঢুকে গেছে। আর বৃষ্টি তো চলছেই। সব মিলিয়ে যারা কাজে বের হয়েছেন তারা খুব ভোগান্তিতে আছেন।
রাজধানীর সদর ঘাট থেকে ছেড়ে আসা অনাবিল পরিবহন বাসের এক চালক বলেন, গুলিস্তান থেকে পল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর, আবুল হোটেল, রামপুরা বাজার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়ে আছে বৃষ্টির কারণে। বিভিন্ন রাস্তায় জলাবদ্ধতা থাকায় গাড়ি খুব ধীরগতিতে চলছে। অনেক রাস্তায় হাঁটুপানি জমেছে, মানুষ ও গণপরিবহন চলতে খুব ভোগান্তি হচ্ছে। বৃষ্টিতে সড়কজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়ে একই পরিস্থিতি তৈরি হয় মাথার উপরে থাকা যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানমুখী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারেও। রায়েরবাগ থেকে এই ফ্লাইওভারে গুলিস্তান পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যানবাহনের সময় লেগেছে এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের বেশি।
সেগুনবাগিচার আবদুল গণি রোডে কথা হয় রিকশাচালক আবদুল খালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে সড়ক ডুবে গেলে রিকশা চালানো যায় না। অনেক কষ্ট হয়। আবার গর্তে পড়ে রিকশা উল্টে যাওয়ারও শঙ্কা থাকে। অনেকেই এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
মোটরসাইকেল চালিয়ে অফিসগামী যুবক মো. সুমন মিয়া জানান, এই ঝুম বৃষ্টিতে রেইনকোটেও লাভ হয় না। বৃষ্টিতে ভিজে যেতে হয়। আর কতটা সময় দাঁড়িয়ে থাকব ফ্লাইওভারের নিচে। অফিসে তো অনেক কাজ পড়ে আছে। তাছাড়া অফিসে পৌঁছতে লেট হলে বেতন কাটার শঙ্কাও রয়েছে।
গাবতলী থেকে মহাখালী পর্যন্ত আসা বৈশাখী বাসের যাত্রী মাসুদ রানা বলেন, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট আসার রাস্তায় পানি জমেছে। বৃষ্টিতে সকাল থেকেই মানুষ খুব ভোগান্তির মধ্যে আছে। এর মধ্যে এখানে জলাবদ্ধতার কারণে যানজট সৃষ্টি হতে দেখেছি।
ধানমন্ডি ২৭, নিউমার্কেট এলাকার জলাবদ্ধতার বর্ণনা দিয়ে সেদিক থেকে আসা সিএনজিচালক শরীফুল ইসলাম বলেন, অনেক সড়কেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এর মধ্যে নিউমার্কেট এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটা সিএনজি ঠেলে নিয়ে যেতে দেখেছি। পুরো রাস্তায় যানজট আর মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি।
একটানা বৃষ্টিতে পানিতে বিকাল পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা এলাকা, মাতুয়াইলের মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং টিকাটুলি থেকে মতিঝিলের জীবন বীমা ভবন পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে তলিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া রাজধানীর শ্যামপুর, কদমতলী, ধোলাইপাড়, জুরাইন এলাকার মুরাদপুর, মেডিকেল হাইস্কুল রোড, পোকারবাজার, বৌবাজার, মাদরাসা রোডসহ কিছু কিছু রাস্তা সারা বছরই পানিতে ডুবে থাকে। কিন্তু গত দুদিনের প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তার পানি উপচে দোকানপাট ও বাসা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। ফলে দোকানের অনেক মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যায় এবং ঘরে হাঁটুপানি হওয়ায় আসবাবপত্র সব ভিজে যায়।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর রাস্তা সংস্কার না হওয়ার কারণে ড্রেনেজগুলে ময়লায় ভরে গেছে। সিটি করপোরেশন ও এলাকার কাউন্সিলরসহ লোকজনের গাফলতির কারণে আজ আমরা পানিতেই বসবাস করছি অনেক বছর। আর এই ভারী বৃষ্টিপাতে আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তো হচ্ছেই।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি আজ রোববার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায়ও বৃষ্টির আভাস দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। তবে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
আবহাওয়ার সতর্কবার্তায় বলা হয়, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা আছে বলে সতর্ক করা হয়েছে ওই বার্তায়।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

সম্পর্কিত পোস্ট