সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ৯ রাজনৈতিক দলের সংলাপ

চতুর্থ দফায় ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অংশীজন ৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট সংলাপে বসে। সংলাপে দলগুলো দ্রুত সংস্কার কমিশনের কাজ শেষে ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। সংলাপে অংশ নেওয়া নেতারা বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এরমধ্যে একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ দিতে বলেছি সরকারকে। সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার দাবি করেছি।
শনিবার (১৯ আক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এ দাবি জানিয়েছেন। এ সংলাপে ৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
দলগুলো হলো- গণফোরাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দল, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি),  বাংলাদেশ জাসদ (শরীফ নুরুল আম্বিয়া), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। সংলাপ শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ-সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মো. মাহফুজ আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলগুলোর নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের গণহত্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গণহত্যার উসকানিদাতা বিষয়সহ দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে কথা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও শরিক দল নিষিদ্ধের বিষয়েও কথা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে দ্রুত সার্চ কমিটি হবে। পাশাপাশি হালনাগাদ ভোটার তালিকা হবে। এই কমিটি ঠিক করবে কারা নির্বাচন কমিশনার হবেন। কমিশনাররা এসেই নির্বাচনের পরবর্তী কাজ শুরু করবেন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সবকিছু গঠিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, আওয়ামী লীগের তিনটি অবৈধ পার্লামেন্ট নিয়ে আজকের বৈঠকে কথা হয়েছে। এটা বাতিলের বিষয়ে কথা হয়েছে। তারা অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে জাতীয় পার্টি নীরব সমর্থন দিয়েছে এবং ভোটে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল, এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ শেষে গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়েছে গণফোরাম। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে, ভালো লোক নিয়োগ দেওয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনো সমস্যা না হয়। তবে নির্বাচনি রোডম্যাপের আমরা কোনো তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি সংস্কার শেষে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য।

নির্বাচনের আগে থাকি রাম, নির্বাচনের পরে হই রাবণ। ওই ধরনের নির্বাচন কমিশন চাই না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন চাই। সবাইকে ঐকমত্য হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকারকে রক্ষার স্বার্থে অর্থাৎ আমাদের নিজেদের রক্ষার স্বার্থে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। আর সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাবনা দুয়েক দিনের মধ্যে আলোচনা করে লিখিত আকারে দেব।
সংবিধান, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সংলাপে গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি।
 সিন্ডিকেটকে অবশ্যই ভাঙতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশটাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ থেকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আমরা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করব। জনগণের জন্য দরজা খোলা আছে বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন।

তিনি বলেন, পাচার হয়ে যাওয়া লাখো কোটি টাকা ফেরত আনতে হবে। দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। সেটা উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সেটা কোনো দলীয় চিন্তা-চেতনা নয়, জাতীয় ঐকমত্যের চিন্তায় এগোতে হবে।
আটটি দিবস বাতিল করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, জাতীয় দিবস ছাড়া কোনো দিবসই রাখা উচিত নয়।
এতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন=গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু, কো-চেয়ারম্যান এস এম আলতাফ হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, সদস্য এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিউদ্দিন আবদুল কাদের, মোশতাক আহমেদ ও সুরাইয়া বেগম।
এদিকে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন,  আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, সংবিধান সংস্কারের মালিক জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। সংবিধানের মেজর পরিবর্তন করবে নির্বাচিত সরকার। আপনারা তা করবেন না। অর্থ পাচারে জড়িত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালকদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে জোট।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন করে আরও ২৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ।
সংলাপে লিখিত ও মৌখিক প্রস্তাব তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে অলি আহমদ বলেন, দুই দফা সংলাপের প্রথমবারে ১০৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় দফায় এবার আরও ২৩টি প্রস্তাব দিয়েছি। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সুন্দর প্রশাসন চালানোর জন্য, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য, নিত্যপণ্যের বাজার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে।
জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি মানুষ যুদ্ধ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা পুলিশসহ প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে, জনগণের সঙ্গে মুখোমুখি করে দিয়েছে, দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে, আমাদের হাজার হাজার ছেলে-মেয়েকে হতাহত করেছে। আমরা মনে করি, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তখন আমরা তাদের নিষিদ্ধ করেছিলাম। তা হলে আজ কী কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে না? আমরা আবার বলেছি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, সম্প্রতি ওনারা বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চ নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা বলেছি, শেখ হাসিনা সরকারের পারিবারিক কর্মকাণ্ডের দায় তার। শেখ হাসিনা সরকারের ভুলত্রুটির দায় বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপানোর যৌক্তিকতা নেই। তাই আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদের বক্তব্য সংশোধন করা উচিত।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ‘লন্ড্রেড মানি রিকভারি’ নামে একটি কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।  তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যার বাইরে আরেকটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির টাকা; ‘লন্ড্রেড মানি রিকভারি’ নামে একটা কমিশন করা হোক। পাচারের মাধ্যমে যে টাকা চলে গিয়েছে সে টাকাটা যাতে ফেরত আসে।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন জানিয়ে পার্থ বলেন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল, রাজনৈতিক দল হিসেবে ওনাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? নিষিদ্ধ করতে হবে, নিষিদ্ধ হবে সেটা মুখ্য না, কিন্তু একটা ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি তাদের বিরুদ্ধে। আমি মনে করি, রাজনীতিটা নৈতিক জায়গা থেকে করা উচিত। আওয়ামী লীগ ৩টি অবৈধ নির্বাচন করেছিল, সেই বিষয়ে কোনো স্টেপ নেওয়া যায় কি না আমরা সেই ব্যাপারে বলেছি।
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের (আওয়ামী লীগ) যেসব প্রেতাত্মা এখনও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে আছে তাদের আমরা অপসারণ করতে বলেছি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও অবিলম্বে এই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করা প্রয়োজন তিনি সেই পদক্ষেপ নেবেন।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে এনে সুশাসন কায়েম করতে হবে। আমরা সংস্কারের বিষয়ে একমত পোষণ করেছি। ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করে তৃণমূল থেকে স্বৈরাচারকে উৎখাতের কথা বলেছি। সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবে গঠিত সরকারকে এখন বিপ্লবী আচরণ করতে হবে, ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন করতে হবে। যেসব দল ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

সম্পর্কিত পোস্ট