সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করল সরকার, প্রজ্ঞাপন জারি

আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা-২-এর দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়।
এতে আরও বলা হয়, গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িত আছে।
এই অবস্থায় সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮-এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং ওই আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধসত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়।
এর আগে বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) কালো ক্যাপ ও মুখোশ পরে ঝটিকা মিছিল করেছে ছাত্রলীগের ৮ থেকে ১০ জন নেতাকর্মী।
এক ভিডিও ক্লিপে দেখা  যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে কলা ভবনের পেছন দিয়ে শ্যাডোর দিকে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ৪৭ সেকেন্ডের এই ভিডিও ক্লিপটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি সংবলিত স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের। এর কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা ভোরবেলা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে মিছিল করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাতের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বুধবার রাত পৌনে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। পরে তারা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে মিছিল শেষে ভিসি চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারা টোকাইদের ভাড়া করে ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আমরা পরে তাদের হল থেকে বিতাড়িত করলেও সারা দেশে তারা অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের চিরতরে নিষিদ্ধের দাবি জানাই। এ সময় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা, ‘ছাত্রলীগ জঙ্গি, গণহত্যার সঙ্গী’, ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘হেলমেট বাহিনী/সুশীল বাহিনী, নো মোর নো মোর’, ‘ছাত্রলীগের ঠিকানা, এ ক্যাম্পাসে হবে না’, ‘শিক্ষা ছাত্রলীগ, একসঙ্গে চলে না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এদিকে সরকারের প্রতিনিধিদের থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের আশ্বাস চেয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। অন্যথায় আবারও অবস্থান কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। বুধবার রাতে এক ব্রিফিংয়ে মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, বুধবার বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আমাদের বৈঠক হয়েছে। সশরীরে আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। অনলাইনেও যুক্ত ছিলেন অনেকে। সেখানে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার মধ্যে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে নীতিগত সম্মতি জানিয়েছেন সরকারের প্রতিনিধিরা।
তবে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ চললে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাতের মধ্যেই ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামে। সংগঠনটির প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন খালেক নেওয়াজ খান। পরবর্তীকালে এই সংগঠনের নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। তবে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তর্কোন্দল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ।

সম্পর্কিত পোস্ট