গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর টানাপড়েন অতিক্রম করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে ঢাকা। পররাষ্ট্র সচিব জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত রোববার নিউইয়র্কে গেছেন। সেখান থেকে তিনি দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে যাবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকার নতুন রাষ্ট্র গঠনে যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গত রোববার রাতে ঢাকা ছাড়েন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন। নিউইয়র্কে তিনি ১০ অক্টোবর পর্যন্ত জাতিসংঘের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করবেন। সেখান থেকে পররাষ্ট্র সচিব ওয়াশিংটন যাবেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ করবেন।
ওয়াশিংটন সফরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত আন্ডার সেক্রেটারি জন বাস, বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিন্ডসে ফোর্ড, সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গেও পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকের কথা রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের আগের সরকারের সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং ভোট ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপে রেখেছিল। আগের সরকারের সময়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং ভোট ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের সমালোচনা করেছিল এবং নিষেধাজ্ঞাসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। ৫ আগস্টের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর ওয়াশিংটন ঢাকাকে সহযোগিতার বার্তা দিয়েছে। কেবল তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। যা একটি বিরল ঘটনা। জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশ্বব্যাংক সহযোগিতার অংশ হিসেবে সহজশর্তে বাংলাদেশকে সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা ঋণ দেওয়ার বার্তা দিয়েছে।
এ ছাড়া জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশ ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর আগে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দেড় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে। ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সঙ্গে বাংলাদেশের ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি হয়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানিয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্র যেসব ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা এবং সহায়তা করার বার্তা দিয়েছে, পররাষ্ট্র সচিবের ওয়াশিংটন সফরে সেসব বিষয় আরও খোলাসা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দুর্নীতি দমনসহ বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে ওয়াশিংটন আরও কীভাবে সহযোগিতা করবে সব ইস্যুতে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, বিগত ২০০৯ সালে আগের সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু আগের সরকার ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকতে থাকলে গত ২০১৪ সালের পর থেকে দুই পক্ষের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। ২০২১ সালে টানাপড়েন গুরুতর পর্যায়ে যায়। মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ একাধিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিষেধাজ্ঞাসহ একাধিক চাপে রাখার কৌশল নেয়। মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুর কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ২০২১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশ নয়, এই অঞ্চলের অন্যদেশগুলোর জন্য তাদের পলিসি আপডেট করেছে।
অধ্যাপক নাজমুল আরও বলেন, গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র আগের সময়ের সরকারের থেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। কেননা বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে যে নীতি রয়েছে তা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে তারা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে, এই বিশ্বাস ওয়াশিংটনের আছে। যার ওপর ভিত্তি করে দুই পক্ষের সম্পর্ক সামনের দিনে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ডা. খলীলুর রহমান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিপক্ষে ছিল, এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি বিগত ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করে যাচ্ছে, এটাও সত্য। আগে থেকেই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ খুব ভালো। এখন পর্যন্ত সব সরকারের আমলেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই সহযোগিতা আওর বাড়বে। কারণ হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সব স্তরের যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় তারা সহযোগিতা করবে। দুই পক্ষের সম্পর্ক আরও উন্নতির দিকে যাবে।
পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ডা. খলীলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন, যা খুবই ইতিবাচক। কেননা তিনি সেখানে বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রদূত পদে কাজ করেছেন, তাই তারও সেখানে জানাশোনা আছে, যা এই সফরে কাজে লাগবে। এ ছাড়া চীন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি রয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ঠিক এর আগে বেইজিংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূত ছিলেন। তাই চীন ইস্যুতেও তার ভালো জানশোনা রয়েছে, যা বাংলাদেশ নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সঠিকভাবে বার্তা দিতে পারবেন।