- দেশকাল২৪ডটকম
দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পরিকল্পিত সিরিজ বোমা হামলার ১৬ বছর আজ। ২০০৫ সালের এইদিনে বেলা ১১টার দিকে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া সব জেলায় প্রায় ৫০০ পয়েন্টে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চরম ঔদ্ধত্যে শক্তিমত্তা জানান দিয়েছিল জঙ্গিরা।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় ঘটনা। ওই হামলায় দুই জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর নড়ে চড়ে বসে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। নানামুখী চাপের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শুরু করে সাঁড়াশি অভিযান। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবির শীর্ষ নেতাদের। কিন্তু কীভাবে একযোগে দেশজুড়ে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল এই জঙ্গি সংগঠনটি? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাই বা তখন কেমন ছিল?
পুলিশ কর্মকর্তা, র্যাব, বিশ্লেষক ও জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৫ সালের আগে থেকেই জঙ্গিরা নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। কিন্তু বিষয়টি ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়নি সেসময় এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও ছিল গা-ছাড়া ভাব। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মূলত সারাদেশে একযোগে হামলার পরিকল্পনা করেছিল জেএমবি বা জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর এবং মৌলবাদী রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট এ সারা দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা চালায়। মুন্সিগঞ্জ জেলা ব্যতিত সর্বমোট ৬৩টি জেলায় একযোগে ঐ বোমা হামলা চালানো হয়। এ বোমা হামলার মাধ্যমে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) একটি উগ্রবাদী জঙ্গি দল হিসাবে অত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের মতো একটি প্রগতিশীল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে একটি অকার্যকর মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ বোমা হামলা চালানো হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার পরপরই সারাদেশে ১৬১টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি। যারমধ্যে ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০ জন। এবং গ্রেপ্তার করা হয় ৯৬১ জনকে। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলার রায় প্রদান করা হয়েছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জেএমবির বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রেপ্তার হওয়ার জঙ্গিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। মূলত জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা আমির শায়খ আবদুর রহমান গ্রেপ্তারের পর তখন তার জবানবন্দিতে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
তারা বাংলাদেশকে ৬ টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পরে তারা দাওয়াত ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে তাদের সংগঠনের প্রচার প্রচারণা শুরু করে। এভাবেই সারা দেশে তারা কর্মী সংগ্রহ শুরু করে সংগঠনটি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় তাদের কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানায়, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই বছর দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে জেএমবি। এরপর তারা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা তৈরির ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০১ সালে জেএমবির শুরা কমিটি নতুন করে গঠিত হয়। শুরা কমিটি গঠনের পর শাহেদ বিন হাফিজ ও রানা জেএমবি ছেড়ে দেয়। ওই সময় শুরা সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আসাদুজ্জামান হাজারী, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে।
জানা যায়, ২০০১ সালে জেএমবি প্রথম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে, পরের বছর অর্থাৎ ২০০২ সালের ১ মে নাটোরের একটি সিনেমা হলে এবং একই বছরের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা করে।
বর্তামান জঙ্গিদের অবস্থান সর্ম্পকে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সফল অভিযানে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে। সিটিটিসির ২৩ টি হাই রিস্ক অপরাশনে নিহত হয়েছে ৬৩ জন সন্ত্রাসী।
জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, জঙ্গিবাদের মূল জায়গা পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা যদি এখনকার পরিবেশের সঙ্গে তখনকার পরিবেশকে তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে, জঙ্গিরা তখন যেভাবে তাদের কর্মকাণ্ড করতে পেরেছে, চলাচল করতে পেরেছে, যেটাকে আমরা ইংরেজিতে বলি ‘ফ্রিডম অব অ্যাকশন’, সেটি পায় যদি নিরাপত্তা বাহিনী নির্লিপ্ত থাকে। তখনকার দিনের যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে বা তাদের (জঙ্গিদের) মুখ দিয়েই বেরিয়ে এসেছে যে, তারা অনেক ফ্রিডম অব অ্যাকশন ভোগ করেছে। যার ফলে তারা এসব পরিকল্পনা, বোমা বহন, বোমা তৈরি এগুলো কোনও ধরনের ব্যত্যয় বা বিঘ্নতা ছাড়া খুব ভালোভাবে করতে সক্ষম হয়েছে।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, ১৭ই আগষ্টে সারাদেশ ব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত ৬৭ জন আসামীকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে র্যাব এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ১,৩৭৩ জন জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সর্বমোট দুই হাজার ৬০০ জন জঙ্গি নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
এসব গ্রেপ্তার জঙ্গি সদস্যদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৫০ ধরনের গ্রেনেড/ককটেল, ১৩৯টি বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র, পাচ হাজার ৪০৪ রাউন্ড বিভিন্ন প্রকারের গোলাবারুদ, ২৮১২.৩ কেজি বিভিন্ন প্রকারের বিস্ফোরক, ৬৩২টি গ্রেনেড বডি, ৯২২৪টি বিভিন্ন প্রকারের ডেটোনেটর এবং বিপুল সংখ্যক সাংগঠনিক এবং জিহাদি বই/সিডি/লিফলেট/পোষ্টার উদ্ধার করা হয়।
জেএমবির বতর্মান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জেএমবি ছাড়াও হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাওহীদ, হিজবুত তাহরীর, আনসার আল-ইসলামসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধেও র্যাবের তীক্ষ্ণ গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সাইবার জগতে উগ্রবাদীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে র্যাব সাইবার মনিটরিং সেল তীক্ষ্ণ সার্বক্ষণিক সাইবার জগতে নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। যখনই জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে তখনই তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করে তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছে র্যাব।
খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, জঙ্গি দমনে র্যাব সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় করে কাজ করেছে। পাশাপাশি র্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দারাও গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যহৃত রেখেছে। সাইবার জগতে নিয়মিত সাইবার মনিটরিং পেট্রোলিং করছে ব্যাব। সার্বিকভাবে বলা যায় ১৭ আগস্ট ঘিরে কোন ধরনের নাশকতা বা নিরাপত্তা ঝুঁকির তথ্য নেই।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ওই বোমা হামলার ঘটনায় ৬৩টি জেলায় ১৬১টি মামলা হয়। ওই বছরের ১৪ই নভেম্বর ঝালকাঠিতে জঙ্গিদের বোমা হামলায় দুইজন বিচারক নিহত হওয়ার মামলায় পরবর্তীতে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই মামলাতেই ২০০৬ সালের ৬ই মার্চ সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। ২০০৬ সালের ১৬ই অক্টোবর এদের একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এছাড়া জেএমবির আমীর শায়খ আব্দুর রহমান,দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মো. সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং খালেদ সাইফুল্লাহ ও আতাউর রহমান সানীর মতো শুরা সদস্যদের ফাঁসির আদেশ ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।