মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

জলবায়ু সম্মেলনে শেখ হাসিনাসহ যে পাঁচজনের ভূমিকা সর্বাধিক

  • দেশকাল ২৪ ডটকম

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে করণীয় নির্ধারণ করতেই জলবায়ু সম্মেলনে বসে বিশ্বনেতৃত্ব। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের স্বার্থ এবং প্রাধান্য বিভিন্ন রকমের। আলোচনায় দরকষাকষির জন্য বিভিন্ন দেশ একে অপরের সাথে জোটবদ্ধ হয়। আবার দেশগুলো একই সাথে বিভিন্ন গ্রুপের বা জোটের সদস্যও হয়।

গ্রেটা টুনবার্গ, স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরো এবং বিশ্ব নেতারা যখন জলবায়ু সম্মেলনে গণমাধ্যমের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন, তখন বিশ্বের ১৯৭টি দেশকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আসল কাজটি করতে হচ্ছে কম পরিচিত কূটনীতিবিদ, মন্ত্রী কিংবা মধ্যস্থতাকারীদের ।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য কোনো চুক্তি কিংবা মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য আলোচনা বেশ দীর্ঘ হয়। অনেক সময় সারারাত ধরে চলে এবং সময়মতো শেষ হয় না। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে চলমান জলবায়ু সম্মেলনের সফলতা এবং ব্যর্থতার উপরে যাদের প্রভাব থাকবে সে রকম পাঁচজনের বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো-

শেখ হাসিনা: দুর্গতদের কণ্ঠস্বর

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সেসব দেশের সমন্বয়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফোরামের কণ্ঠস্বর।

তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং বেশ সোজাসাপ্টা কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশগুলো কী ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে, সেটির অভিজ্ঞতা তিনি এই সম্মেলনের তুলে ধরেন।

ব্রিটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. জেন অ্যালান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তি জলবায়ু সম্মেলনের মানবিক প্রতিচ্ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি দেখতে কেমন হয় সেটি তিনি বিশ্ব নেতাদের বোঝাতে পারবেন। যদিও এসব দেশ দরিদ্র, তবুও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের ভালো রেকর্ড রয়েছে।

ড. জেন অ্যালান বলেন, এসব দেশ যে জোরালো ভাষায় কথা বলছে, তার পেছনে তাদের শক্ত নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জাতিসংঘের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভালো একটি চুক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলো একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গ্লাসগো সম্মেলনে গিয়েছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য বিশ্বনেতাদের সামনে চার-দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলো হলো-

১. শিল্পোন্নত দেশগুলো যাতে তাদের কার্বন নিঃসরণ ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা উপস্থাপন করে।

২. ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড নিশ্চিত করা।

৩. উন্নত দেশগুলো যাতে কম খরচে এবং সহজে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে গ্রিন টেকনোলজি দেয়।

৪. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তু-চ্যুত হচ্ছে তাদের দায়িত্ব নেয়া।

শিয়ে জেনহুয়া: চীনের সব ঋতুর ব্যক্তি

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চীনের বিশেষ আলোচক শিয়ে জেনহুয়া অবসরে গিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু চলতি বছরের শুরুর দিকে তাকে প্রধান আলোচকের ভূমিকায় আনা হয়। এর কারণ সম্ভবত তিনি আমেরিকার সিনেটর জন কেরির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।

জন কেরি বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আমেরিকার বিশেষ দূত। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি তৈরির ব্যাপারে শিয়ে জেনহুয়া এবং জন কেরির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই চুক্তিতে শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

কিন্তু ২০২১ সালের গ্লাসগো সামিটের উদ্দেশ্য ভিন্ন রকম। জন কেরি চায় চীন কার্বন নি:সরনের মাত্রা আরো ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনুক। কিন্তু চীনের বিশেষ আলোচক শিয়ে জেনহুয়া বলেছেন, গ্লাসগো সম্মেলন হচ্ছে প্যারিস চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা।

জলবায়ু সম্মেলনে চীনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ। তাছাড়া কপ টোয়েন্টি সিক্স সম্মেলনে চীন বেশ কয়েকটি জোটের সদস্য। উন্নত দেশগুলোর জোট জি ৭৭ -এর সদস্য চীন। এছাড়া সমমনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোটেও রয়েছে চীন।

তবে এই সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যোগ না দেয়ায় সমালোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

অলোক শর্মা: সবার মাঝখানে

গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে সব পক্ষকে এক জায়গায় এনে সফল পরিসমাপ্তির দায়িত্ব অলোক শর্মার, যিনি কপ টোয়েন্টি সিক্স-এর প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টিতে রয়েছেন শর্মা।

বিভিন্ন দেশকে এক জায়গায় নিয়ে আসার যে চেষ্টা তিনি করছেন, সেজন্য এরই মধ্যে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তার প্রতিটি কথা এবং কাজের প্রতি সবার দৃষ্টি থাকবে।

অলোক শর্মার রোল মডেল হতে পারেন ফ্রান্সের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরো ফ্যাবিয়াস। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পেছনে তার বড় ধরনের ভূমিকা ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য যেসব দেশ তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি, সেসব দেশকেও একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ফ্যাবিয়াস।

আয়মান সাসলি : সৌদি আরবের রক্ষক

বিভিন্ন আরব এবং উন্নয়নশীল দেশ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার জন্য সৌদি আরবের কাছ থেকে ধারণা নেয়। তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া গ্লাসগো সম্মেলন সফল হবে না।

গত এক দশক যাবত সৌদি আরবের আয়মান সাসলি ‘আরব গ্রুপ অব ক্লাইমেট নেগোশিয়েটরস’- এর চেয়ারম্যান।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর সাবেক কর্মকর্তা সাসলির বর্তমানে অনেক পরিচয় রয়েছে। জাতিসংঘের আইপিসিসিতে সৌদি আরবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাসলি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেবার পক্ষে ছিল না সৌদি আরব। যদিও সম্প্রতি দেশটি তাদের সে অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয়। ২০৬০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হাজির করেছে দেশটি। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক দেশটি।

আলোচনার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের স্বার্থ জোরালোভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাসলির বড় ভূমিকা রয়েছে।

২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাসলি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্য দেশের তুলনায় সৌদি আরব সম্ভবত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা একটি মরুভূমির দেশ এবং আমাদের আয়ের একটি মাত্র উৎস আছে। আমাদের অর্থনীতি ভঙ্গুর। তেল বিক্রি করে আমরা খাই, মানুষকে শিক্ষা-চিকিৎসা সবকিছুই দেই।

টেরিজা রিবেরা: ইউরোপের সেতুবন্ধন

স্পেনের টেরিজা রিবেরা গত কয়েক দশক যাবত জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে মিস রিবেরা স্পেনের একোলজিক্যাল ট্রানজিশন বিষয়ক মন্ত্রী।

স্পেনে কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসার বিষয়ে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট না করে কিভাবে একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা যায় সেক্ষেত্রে স্পেন একটি রোল মডেল।

ধনী দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলো চায় সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ কমাতে। অভিজ্ঞ আলোচক মিস রিবেরা জানেন, এক্ষেত্রে অগ্রগতি করতে হলে সমমনা দেশগুলোকে নিয়ে জোটবদ্ধ হতে হবে।

গ্লাসগো সম্মেলন সফল হতে হলে দক্ষিণ আমেরিকা, চীন এবং আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব দেশের সাথে টেরিজা রিবেরার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। বিবিসির সৌজন্যে

সম্পর্কিত পোস্ট