মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ঠিকানাহীন’ অদম্য মেধাবী শোভার ঠিকানা দেশসেরা ৫ বিশ্ববিদ্যালয়! ভর্তির সুযোগ বুয়েট

দেশকাল ২৪ ডটকম

জন্মের আগেই বাবাহারা হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শোভা। ‘অপয়া’ সেই শোভাকে নিয়ে মা প্রতিমা রানী দাশ শুরু করেন নিরন্তর সংগ্রাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় শোভা রানীও যোগ দেয় মায়ের সংগ্রামে। অবশেষে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ‘ঠিকানাহীন’ শোভা ঠিকানা করে নিলেন দেশসেরা ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে! সুযোগ পেলেন বুয়েটে।

এই যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনিয়েছেন শোভা রানী দাশ ও তার মা প্রতিমা রানী দাশ

আমি মায়ের গর্ভে থাকতেই বাবা মারা যান। ফলে জন্মের পরপরই লোকের কাছে ‘অপয়া’ ছিলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন মা মামার বাড়ি গেলেন।

মার দিদিমাও মারা গিয়েছিলেন। পরে দাদু দ্বিতীয় বিয়ে করেন। যে কারণে মামাবাড়িতেও এক ধরনের আগন্তুকের মতো ছিলাম। স্থানীয় একটা স্কুলে দপ্তরির কাজ করতেন মা। তত দিনে আমি অ আ ক খ শিখে ফেলেছি।

সেই সময়কার একটা ঘটনা মনে আছে। একটা জামা বা কীযেন কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরেছিলাম। মায়ের হাতে পয়সা নেই। পরে ঘরের মুরগির ডিম বিক্রি করে সেটা কিনে দিয়েছিলেন। এটা জানতে পেরে মামা রাগ করে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিলেন।

একটা পোঁটলা আর আমাকে নিয়ে মা বাড়ি ছাড়লেন। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। মায়ের চোখে জল।

কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা যে আমাদের নেই! দিদিমার নিজের চলাই দায় উপায়ান্তর না দেখে মা তখন তাঁর পিসির বাড়িতে গেলেন। কিন্তু তাঁদের সংসারেও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। দুই-তিন মাস পর মায়ের একটা কাজ জুটল।

কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ। সেই বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা রুমে আমরা থাকতাম। সেখানে বেগমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বাড়িওয়ালা বললেন, ‘কাজ করে একজন। খায় দুজন। তোমার মেয়েকে কেন রাখব?’ এক পর্যায়ে সেই বাসাও ছাড়তে হলো। কিন্তু কোথায় যাবে মা? অনন্যোপায় হয়ে আবার গন্তব্য মামাবাড়ি।

অনুনয়-বিনয়ের পর মামার দয়া হলো। সেখানে একটা স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হলাম। তত দিনে কোনো কাজ জোগাড় করতে পারেননি মা। ফলে মাস দুয়েক পর আবার মামার বাড়ি ছাড়তে হলো।

এবারও শেষ ঠিকানা মায়ের সেই পিসির বাড়ি। পরে মা সেই বাড়িতে আমাকে রেখে কুমিল্লা চলে গেলেন। এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ পেলেন। মা যে বাসায় কাজ করতেন বছরখানেক পর তারাও অন্যত্র চলে যায়। ফলে মা আবার গ্রামে ফেরেন।

আবার বিয়ের পিঁড়িতে তখন অবস্থা এমন যে মামার বাড়িতেও আমাদের ঠাঁই নেই, দিদিমণির বাড়িতেও থাকার উপায় নেই। এদিকে আমি বড় হচ্ছি। মা-মেয়ের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। আজ এখানে তো কাল ওখানে।

ফলে প্রতিবেশীরা চাচ্ছিল মাকে আবার বিয়ে দিতে। কিন্তু মা রাজি ছিলেন না। অনেকে বোঝানোর পর আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই রাজি হলেন। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি।

বিয়ের পর কুমিল্লা থেকে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে চলে আসি। সেখানে আদর্শ কিন্ডারগার্টেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম।

পিএসসি পাসের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া গভর্নমেন্ট মডেল গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। কয়েক শ শিক্ষার্থীর মধ্যে আমিসহ মাত্র ১২০ জন ভর্তির সুযোগ পেল।

স্কুলের কাছেই ছিল নিউ অক্সফোর্ড কোচিং সেন্টার। সেখানে দিদার স্যার এবং পার্থ স্যার অল্প টাকায় আমার পড়ার ব্যবস্থা করলেন। স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ৮ম হয়েছিলাম!

বাবা ছিলেন উদাসীন তাঁর সহায়-সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। চায়ের দোকানে কাজ করতেন। একদিন কাজ করলে দুই দিন বসে থাকতেন। ছোট্ট এক রুমের ভাড়া বাসায় উঠিয়েছিলেন আমাদের।

ঠিকমতো চাল-ডাল আনতেন না। ঘরভাড়াও বাকি পড়ত। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়াঝাঁটি হতো। একটু উচ্চবাচ্য করলেই মায়ের ওপর চলত নির্যাতন।

পড়ার টেবিলে বসে আমি কাঁদছি। চোখের জলে বইয়ের পাতা ভিজে গেছে কত দিন! খাবারদাবার বা অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু প্রার্থনা করতাম, আমাকে এমন একটা পরিবেশ দাও যেন একটু পড়তে পারি। জীবনে আর কিছুই চাই না। শুধু পড়াশোনা করতে চাই!

টিউশনি শুরু করলাম তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। খাবার, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সব কিছু মাকেই জোগাড় করতে হতো। স্থানীয় একটা কারখানায় আচার, চকোলেট ইত্যাদির প্যাকেট বানাতেন মা। আচারের এক হাজার প্যাকেট বানালে ৩০ টাকা পেতেন।

আমি এলাকার কয়েকটা বাচ্চাকে পড়ানো শুরু করলাম। সপ্তাহে সাত দিন। মাসে একেকজনের কাছ থেকে ৫০-১০০ টাকা করে পেতাম। জীবনে কোনো দিন অপচয় করেছি বলে মনে পড়ে না। যতটুকু লাগত তার চেয়ে কম বৈ বেশি চাইনি।

দিন দিন পড়াশোনার খরচ বাড়ছিল। আমাদের এমন করুণ অবস্থার কথা স্কুলে তখনো জানত না। স্কুলে সব বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে। সব সময় মনে হতো তারা জানলে কী ভাববে। চোখের জল ফুরাত না জেএসসি পরীক্ষার রাতগুলোও খুব কষ্টের ছিল।

বাবা প্রায়ই এসে ঝগড়া করতেন। রাতে ঘুমাতে যেতাম কাঁদতে কাঁদতে। সকালে উঠে কোনো মতে পরীক্ষার হলে যেতাম। এসবের মধ্যেও পড়তে চেষ্টা করতাম। জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম। বৃত্তিও পেলাম।

নবম শ্রেণিতে চেয়েছিলাম কমার্সে পড়তে। কারণ বিজ্ঞানে পড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য নেই। পরে স্যাররা পাশে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি বিজ্ঞানেই পড়বে। নবম ও দশম শ্রেণিতে ক্লাসে প্রথম হয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম আর হবে না, ক্লাস নাইনে ওঠার পর ভেবেছিলাম, আর পড়াশোনা করব না। এমন পরিস্থিতি কত সহ্য করা যায়? আগে তো বাঁচতে হবে। একদিন বইপত্র সব বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলেছি।

মাকে বললাম- চলো, যাই। কিন্তু প্রতিবেশীরা তখন বুঝিয়েছে। কোচিং সেন্টারের স্যাররাও বলেছেন, কষ্টসৃষ্টে এই স্কুল থেকেই এসএসসি শেষ করো। ফলে আবারও সৎবাবার ঘরে ফিরে গেলাম।

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন খবর পেলাম, আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে একটা বৃত্তি এসেছে। ক্লাসে দাঁড়িয়ে ম্যাডামকে বললাম, বৃত্তিটা পেলে খুব উপকার হবে। বৃত্তিটা পেলাম।

এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস এবং বৃত্তি পেয়েছি। এসএসসিতে পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাবা ঘর থেকে বের করে দেন। রাতভর কিছুই পড়তে পারিনি। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮ নম্বর পেয়েছিলাম।

এসএসসিতে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও উচ্চতর গণিতে আমার গড় নম্বর ছিল ৯৮.৯১। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনও একই ঘটনা ঘটল। তখনো ভেবেছিলাম, আর নয়। কোচিং সেন্টারের স্যাররা আবার বোঝালেন।

পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। তখন একটা বেসরকারি ট্রাস্ট থেকে অদম্য মেধাবী হিসেবে বৃত্তি পেলাম। অবশেষে ঘর ছাড়লাম এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে শহরে একটা মেসে উঠলাম।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে কেন্দ্রবিন্দু একাডেমিক কেয়ারে বিনা পয়সায় কোচিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। তারা বৃত্তি দিত। টিউশনি করতাম। অপুষ্টি, ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে মা তত দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

কিডনি, মেরুদণ্ডের সমস্যাসহ নানা রকম জটিলতায় ভুগছিলেন। নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি মাসে আড়াই হাজার টাকার মতো মায়ের চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো। এসবের মধ্যেই এইচএসসি পরীক্ষা হলো।

এইচএসসি পরীক্ষার আগে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন একটা পরীক্ষার আয়োজন করেছিল। সেখানে নির্বাচিত হয়ে বিনা মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ও হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেলাম। সেই থেকে ঢাকায় হোস্টেল জীবন।

এর মধ্যে ঈদ আসে, পূজা আসে। সবাই নিজ নিজ বাড়ি যায়। কিন্তু আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! মন খারাপ হতো। কিন্তু আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আমাকে হতেই হবে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফরম পূরণ, যাতায়াতসহ সব খরচ দিয়েছিল মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। তারা মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে। যাহোক বুয়েট, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বুটেক্সসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি।

সব কটিতে মেধাতালিকায় প্রথম দিকে আছি। ২৫ নভেম্বর বুয়েটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হলো। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। খবরটা জেনে সবার আগে মাকে ফোন করেছি। মুঠোফোনের অন্য প্রান্তে মা তখনো কাঁদছিলেন। তবে এ কান্না আনন্দের!

শোভার মা প্রতিমা রানী দাশ বলেন, বাচ্চাটারে নিয়ে অনেক কষ্ট করছি। কোনো মতে ডাইল-ভাত খাইয়া বাচ্চাটারে দাঁড় করাইচি। ম্যালা জায়গায় কাজ করচি।

বাবারে তোমারে কী কমু, মালিকেরা তো বেশি ভালা না। মাইয়া মানুষ কোন জায়গায় নিরাপদ? পরে বিয়া কইরা যার কাছে আইছি হেও কষ্ট দিছে। তাও ভাবছি, যতই কষ্ট হউক শোভারে পড়ামু।

বাচ্চাটা টিফিন খাইব। দিমু যে দুইডা টাকা, হেই সামর্থ্য আছিল না। আমার জীবনটা একটা কষ্টের সাগর। আমি তো কষ্ট পাইছি। শোভাও প্রচুর কষ্ট পাইছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাইনসের ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারুম না।

সম্পর্কিত পোস্ট