প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হচ্ছে। তবে রমজান পলক্ষে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব প্রকার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্য আলী আজমের এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকার সব সময় সচেষ্ট। ইতোমধ্যে আমরা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে অনেকাংশে সংযত করতে পেরেছি। তবে, বিশ্ববাজারের কয়েকটি পণ্য যেমন জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, গম, সারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হচ্ছে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নীতি (রেপো) সুদহার দফায় দফায় বাড়িয়ে মে ২০২২ এর ৪.৭৫ ভাগ থেকে সর্বশেষ ৮.০০ ভাগে উন্নীত করা হয়েছে। পাশাপাশি, রিভার্স রেপো রেট (এসডিএফ) বৃদ্ধি করে ৬.৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে এবং ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। নীতি সুদহার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি করায় বাজারভিত্তিক গড় সুদ হারে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। আশা করছি খুব শিগগিরই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনার লক্ষ্যে ক্রলিং পেগ ভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। নির্ধারিত করিডোরভিত্তিক এ ব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন রোধ করবে। ফলে এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে।
সরকার প্রধান বলেন, আগামী রোজায় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার অভিপ্রায়ে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত যোগানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যতম নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে ভারত সরকারের কাছে ১ লাখ মেট্রিক টন চিনি এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ সরবরাহের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরেও কৃষি বিপণন অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দৈনিকভিত্তিতে কৃষিপণ্যের বাজারদর প্রকাশ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে ঢাকা মহানগরীর ২৫টি স্পটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে দুধ, মাংস ও ডিম বিক্রির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে আমদানি সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশনসমূহ ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল ও খেজুর দ্রুত খালাসকরণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের মূল বাজেটে ওএমএস খাতে ৪ লাখ মেট্রিক টন চালের সংস্থান রয়েছে। সারা দেশে প্রতিদিন ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে ৮৬৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ হাজার ৯৭ মেট্রিক টন আটা বিক্রয় করা হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট ৫টি মন্ত্রণালয় আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করেছে।
টিসিবির মাধ্যমে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে ১ কোটি পরিবারকে ৫ কেজি করে প্রতিমাসে মোট ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল বিতরণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এই ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় চালের পাশাপাশি সাশ্রয়ীমূল্যে ২ কেজি করে ডাল এবং ২ কেজি সয়াবিন তেলও বিতরণ করা হচ্ছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে ১৫ টাকা কেজি দরে এবং সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও জেলা শহরসমূহে ৩০ টাকা কেজি দরে ওএমএস চাল বিক্রয় করা হচ্ছে।
কৃষিখাতে প্রদত্ত ভর্তুকি ও প্রণোদনা কৃষকের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে পরোক্ষভাবে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী রাখতে সহায়তা করে। ২০২৩- ২৪ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি ও প্রণোদনা হিসেবে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, অসাধু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রতিটি মিলের পাক্ষিক মিলিং ক্ষমতা ধানের ক্ষেত্রে পাঁচ গুণ থেকে কমিয়ে তিন গুণ করা হয়েছে। মজুত রাখার এ বিধান সংশোধন করায় বাজারে ধানের সরবরাহ বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে এবং অবৈধ মজুত রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
চালকল মালিক এবং খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের গুদাম নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে। অটো রাইসমিলসমূহ হতে চালের বস্তার গায়ে-ধানের জাতের নাম, প্রস্তুতকারক মিলের নাম ঠিকানা, নিট ওজন, উৎপাদনের তারিখ এবং মিল গেটে চালের মূল্যের তথ্য লিখে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
রমজানে তারাবির নামাজের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে নাটোর-১ আসনের আবুল কালামের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, রমজানে তারাবির নামাজ ও সেহরির সময় বিদ্যুতের সংকট হবে না। আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। ভর্তুকি অর্থে তা বিতরণ করি। এখন বিশ্বব্যাপী তেল, এলএনজি ও পরিবহনসহ সবকিছুর মূল্য বেড়ে গেছে।
তারপরও আমাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা রয়েছে। এটা ঠিক যে যেহেতু আমাদের জ্বালানি তেল ও এলএনজির সংকট আছে।কোনো কোনো কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পায় বা ব্যাহত হয়। সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হ্যাঁ, তারাবির নামাজ ও সেহেরির সময় বিদ্যুতের সমস্যা হবে না। বরং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সময় যদি প্রয়োজন হয় দিনের কোনো এক সময় যখন চাহিদা কম থাকে তখন দুই-তিন ঘণ্টা লোডশেডিং করা যায়।
এতে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, আর বিদ্যুতে সংকট কিন্তু হবে না। বিশেষ করে তারাবি ও সেহেরির সময়ে সংকট হবে না। আমাদের প্রচেষ্টা সেইভাবে থাকবে। একসময় দেশে ১০/১২ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকলেও এখন সেই অবস্থা নেই উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তবে আমার মনে হয় মাঝে মাঝে এটি (লোডশেডিং) থাকা ভালো। নাহলে মানুষ অতীতকে ভুলে যাবে। অন্তত উপলব্ধি করবে, কোথায় ছিলাম আর কোথায় আছি।
ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার-
১. মূল্যস্ফীতি কমাতে বিভিন্ন শুল্কছাড় দেওয়া হচ্ছে।
২. অপরিশোধিত সয়াবিন, পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেল আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে ১০ ভাগ এবং উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় ভ্যাট হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
৩. পবিত্র রমজানে খেজুরের চাহিদা বিবেচনায় খেজুর আমদানিতে শুল্কায়নের ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্যকে ভিত্তি ধরে শুল্কায়ন করা এবং কাস্টমস শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (সিডি) ও (আরডি) রহিত করার ৭ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরোপণীয় আমদানি শুল্ক ২৫ ভাগ থেকে হ্রাস করে ১৫ ভাগে নির্ধারণ করা হয়েছে।
৪. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্কহার পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।
৫. চাল আমদানিতে আরোপণীয় সমুদয় আমদানি শুল্ক হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ ভাগের পরিবর্তে ৫ ভাগে নির্ধারণ করা হয়েছে।