প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী যেতে না পারার বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বুধবার (৫ মে) দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে কর্মী যান, এটা স্বাভাবিক। সরকার আইন, সুযোগ-সুবিধা তৈরি করার পরও কেউ কেউ দালাল ধরে যান। কিন্তু এবার মালয়েশিয়া পাঠানোর ক্ষেত্রে কেন এত মানুষ বিড়ম্বনায় পড়ল, সেটি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যখনই সব ঠিক করা হয়, লোক পাঠানোর জন্য তখনই দেশের ও মালয়েশিয়ার এক শ্রেণির ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ী তড়িঘড়ির চেষ্টা করে। ফলে জটিলতা ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাকরি ও কর্ম কিছুই ঠিক থাকে না।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘কিছু মানুষ আছে, দ্রুত তড়িঘড়ি করে যেতে চায়। নিয়ম মানতে চান না। মালয়েশিয়ার ঘটনায় দায়ী যে বা যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, গত শুক্রবার (৩১ মে) পর্যন্ত দেশটিতে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬ জন বাংলাদেশি কর্মীকে পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ছাড়পত্র দেয় প্রায় ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪২ জনকে। অজ্ঞাত কারণে বাদ দেয়া হয় ৩২ হাজার কর্মীকে। কর্মীদের মালয়েশিয়া যেতে জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু বেশিরভাগে কর্মীকেই গুনতে হয়েছে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এরপরও ৩১ মে এর ম্যেধ মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে ৩০ হাজার কর্মীর।
এদিন হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উন্মুক্ত জলাশয় স্থায়ী সংরক্ষণ ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হাওর অঞ্চলে মৎস্য ও জলজ অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হবে।
‘দুর্গম হাওরাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং চলতি বর্ষায় হাওর উন্নয়ন ও বাঁধ সংস্কারে কোন কোন কাজ সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে, এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ঝুঁকি মোকাবিলার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ সরকার। সে লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিপর্যয়গুলো, যেমন লবণাক্ত, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা এবং উপকূল, হাওর ও চরাঞ্চলের বন্যা বিবেচনায় নিয়ে দুর্গম অঞ্চলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি ‘দুর্যোগ আগে বিপর্যয় প্রভাব মূল্যায়ন’ পদ্ধতির প্রণয়নের কাজ হাতে নিয়েছে সরকার।
যার লক্ষ্য হলো, দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট বিপর্যয় সম্পর্কে জ্ঞান এবং তথ্য সংহত করার মাধ্যমে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন ডিজিটাল রিস্ক ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম (ডিআরআইপি) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, যার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রণয়নে দুর্যোগ প্রভাব মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘হাওর, জলাভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বহুমাত্রিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমবায় কার্যক্রমকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), কুমিল্লা অঞ্চলভিত্তিক ফলিত ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের মডেল প্রণয়ন করে থাকে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে বার্ড উপকূল, হাওর ও চর এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নকল্পে বার্ড বরিশাল, চট্টগ্রাম (পার্বত্য এলাকা ব্যতীত) ও সিলেট বিভাগে আঞ্চলিক একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেবে।
‘দারিদ্র্য দূরীকরণে পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন মডেল ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে টেকসই পল্লী উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জামালপুর ও রংপুর এ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলাভূমি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের জন্য হাওর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণের পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকা, দুর্গম চরাঞ্চল ও বিভিন্ন দ্বীপসহ দেশব্যাপী নানা ধরনের ডিজিটাল সেবা দেওয়া হচ্ছে।
‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে সব দুর্গম এলাকা, যেখানে স্যাটেলাইট পরিষেবা প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর নয়, সেখানে অপটিক্যাল ফাইবার/মাইক্রোওয়েরভিত্তিক সঞ্চালন নেটওয়ার্ক স্থাপন করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বৃষ্টিজনিত বন্যার কারণে হাওরাঞ্চলে প্রায়ই ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ডব্লিউএএসএইচ) অবকাঠামোগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
তিনি বলেন, ‘এসব অঞ্চলে সাধারণত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বসবাস এবং তারা মৌলিক ডব্লিউএএসএইচ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। বন্যার কারণে ভঙ্গুরতার শিকার অন্যান্য অঞ্চলের মতো এসব অঞ্চলে বর্ধিত সংখ্যায় আবাসন ও ডব্লিউএএসএইচ অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
‘সবধরনের দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিতকরণে মানবসম্পদের স্বল্পতা বিবেচনায় নিয়ে সেবার মান বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার বহুমুখীকরণ (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বসহ), স্থানীয় পর্যায়ে শিশুদের এআরআই ও ডায়রিয়া প্রতিরোধ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, এনজিওর উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয়, খাদ্য সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় নারীদের/ শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি নিরসনের কার্যক্রম গ্রহণসহ নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,’ বলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, বেড়িবাঁধ, পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও উন্নত করা, বেড়িবাঁধ ও কাঠামো পুনঃস্থাপন, পুনরায় নকশা নিরূপণ ও পরিমার্জন, স্থানিক পরিকল্পনা এবং বন্যার ঝুঁকি জোনিং গ্রহণ, বন্যার সতর্কতার সময় বাড়ানো, অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ উন্নয়ন, জলাশয় এবং যোগাযোগ পুনরুদ্ধার, নদী ব্যবস্থাপনা, খনন ও স্মার্ট ড্রেজিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
‘গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকার জীবিকা এবং প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্মুক্ত জলাশয়ের স্থায়ী সংরক্ষণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে নির্ধারিত বিল ও হাওরাঞ্চলে মৎস্য ও জলজ অভয়ারণ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে মৎস্য শিকারের ওপরে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা থাকবে।’