কোটা পদ্ধতি উঠে যাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কমে গেছে। ৪৩তম বিসিএসে মাত্র ১৭ শতাংশ নারী সুযোগ পেয়েছে। যেখানে ৩৮তম বিসিএসে নারীরা ছিলেন ২৬ শতাংশের ওপরে। কোটাবিহীন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩তম বিসিএসে কমে গিয়ে গড়ে ১৯ শতাংশে নেমেছে। ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সাত নারীসহ ৭০ জন নিয়োগ পান। কিন্তু এই বিসিএসে উত্তীর্ণদের তালিকায় ২৫ জেলার একজনও নেই। শুধু ৪০তম নয়, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসেও একই ক্যাডারে ২০০ জন নিয়োগ পেলেও, যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ জেলা থেকে কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এর মধ্যে তিন বিসিএসেই নেই রাজবাড়ী, রাঙামাটি, বান্দরবান, বরগুনা, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোনো প্রার্থী। কোটা না থাকলে এরকম একটা অসমতা সৃষ্টি হয়। প্রতিটি গোষ্ঠী, প্রতিটি এলাকার মানুষ যেন সমানভাবে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা পায় এজন্য ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা আছে।
কোটা আন্দোলন নিয়ে কুচক্রীমহলের ইন্ধনে কিছু সংখ্যক ছাত্রনামধারী অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাধারণ শিক্ষার্থীর সরলতাকে পুঁজি করে আন্দোলন জোরদার করছে। মধ্যরাতে ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষার্থী। একাত্তরের পরাজিত শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করছে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে। প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশের মত বিভিন্ন শ্রেণী এবং অঞ্চলভিত্তিক কোটা রয়েছে। তাই কোটাপ্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলে রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে উন্নতির ধারাবাহিকতা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে।
২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। এক রিট আবেদনের রায়ে গত ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন হাই কোর্ট। এরপর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি থাকলেও এ সপ্তাহের শুরু থেকে শুরু হয় তাদের অবরোধ কর্মসূচি, যার নাম তারা দেয় ‘বাংলা ব্লকেড’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও এখন তারা মাঠে রয়েছে এক দফা নিয়ে। তাদের দাবি হল- সকল গ্রেডে সকল প্রকার ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে।
নিজের দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবোধ নেই এমন কেউ দেশের প্রকৃত মেধাবী হতে পারেন না। নিজেকে ‘রাজাকার’ দাবি করে এমন মেধা বাংলাদেশ বির্নিমানে কোনো অবদান রাখতে পারবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন আলোচনায় প্রকৃত শিক্ষার্থীরা বলছেন, একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত ঘৃণিত রাজাকার, আলবদরদের দোসররা এখনো সক্রিয়। এই কুচক্রী মহল কোটা আন্দোলনের আড়ালে অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। মেধাবীদের স্লোগান ‘রাজাকার’ হতে পারে না।
জানা যায়, ৪০তম বিসিএসে যেসব জেলা থেকে কেউ পুলিশ ক্যাডারে মেধাতালিকায় আসেননি, সেগুলো হলো– নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, জামালপুর, সিলেট, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, বাগেরহাট, বগুড়া, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর।
এই বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে পাঁচটি জেলা থেকে একাধিক পরীক্ষার্থী পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে হবিগঞ্জ, রংপুর ও কিশোরগঞ্জ থেকে তিনজন করে, কুমিল্লার ৭ ও খুলনা জেলা থেকে ৬ জন নিয়োগ পান। এভাবে ৪১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, ভোলা, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, লক্ষ্মীপুর, শেরপুর ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে কেউ উত্তীর্ণ হননি। এই বিসিএসে ময়মনসিংহ থেকে ৯, ঢাকা ও রাজশাহী থেকে ৫ জন করে এবং বরিশাল থেকে ৪ জন উত্তীর্ণ হন।
একইভাবে ৪৩তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ১০০ জনের মধ্যে ১৪টি জেলার কেউ নেই। জেলাগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও জয়পুরহাট।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা আছে। প্রতিটি গোষ্ঠী, প্রতিটি এলাকার মানুষ যেন সমানভাবে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি উঠে যাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কমে গেছে। যেমন ৪৩তম বিসিএসে মাত্র ১৭ শতাংশ নারী সুযোগ পেয়েছে। যেখানে ৩৮তম বিসিএসে নারীরা ছিলেন ২৬ শতাংশের ওপরে, সেখানে ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩তম বিসিএসে কমে গিয়ে গড়ে ১৯ শতাংশে নেমেছে।
তিনি বলেন, এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, সেখানে সমতার ভিত্তিতে দেশটা এগিয়ে নিতে হবে। ৪০তম বিসিএসে ৫৯টি জেলা থেকে পুলিশে একজন নারীও স্থান পাননি। ১৭টি জেলা থেকে নারী পুরুষ কেউ স্থান পায়নি। তাহলে কোটা না থাকলে এরকম একটা অসমতা সৃষ্টি হয়। সব কিছু বুঝেশুনে যদি তারা আইনজীবীদের দিয়ে কোর্টে বিষয়গুলো তুলে ধরে, তাহলে বিষয়টি সুন্দর সমাধান হবে।
কোটা বৈষম্য নয় বরং বৈষম্য নিরসনে কোটা প্রয়োজন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে কোটা না থাকায় নারীরা পিছিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বৈচিত্র্যময়, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে কোটার গুরুত্ব রয়েছে। কোটা কোনো বৈষম্য নয়, বরং বৈষম্য নিরসনে কোটা প্রয়োজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে।