‘পুলিশ হয়েছে সংস্কার, আমরা হয়েছি জনতার।’ ‘চলো চলো কর্মে চলো, জনগণের সেবা করো।’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পুলিশের কর্মবিরতীসহ সকল কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যরা। আগামীকাল সোমবার (১২ আগস্ট) থেকে তারা সবাই কাজে যোগ দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।
রোববার (১১ আগস্ট) রাতে পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বিষয়টি নিশ্চিত করেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দাবি পুরণের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কর্মস্থলে নিরাপত্তা, ৫ আগস্ট এবং পূর্ববর্তী সহিংসতায় আহত নিহতদের ক্ষতিপূরণ, পুলিশ সংস্কারসহ ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছিল পুলিশ। কয়েকদিন থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, দেশের বিভিন্ন জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছিল। গত ৮ আগস্ট পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যগণ আইজিপির সাথে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অফিস কক্ষে সাক্ষাৎ করে ১১ দফা দাবী তুলে ধরেন মাঠ পুলিশ সদস্যরা। সেখানে দাবি বাস্তবায়নে কমিটিও করে দেন।
বাংলাদেশ পুলিশ বৈষম্য বিরোধী কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক পুলিশের উপপরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পুলিশ আন্দোলন করতে পারেনা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেটির প্রেক্ষিতে আমরা ১১ দফা দাবি নিয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। দাবি আদায়ের জন্য কর্ম বিরতিতে ছিলাম। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টা আমাদের স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমরা আজ রোববার রাতেই প্রতীকি ডিউটি করব।
তিনি আরও বলেন, আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সভা হয়েছে। সেই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আমাদের স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পুলিশকে যেন আর রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা হয় সেটি নিশ্চিত করা হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য দাবি-দাওয়াগুলো পূরণ করা হবে।
কমিটিতে রয়েছেন, এআইজি নাজমুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে কর্মরত পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু, নৌপুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জুয়েল রানা, ডিএমপির সহকারী কমিশনার সৌম্য শেখর পাল, সিআইডির ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট মো. আসাদুজ্জামান জুয়েল, সিআইডিতে কর্মরত এসআই মো. জহিরুল হক ও ডিএমপির কনস্টেবল মো. বরকত উল্লাহ। তাদেরকে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসা এবং তাদের প্রস্তাবসমূহ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন কল্পে সুপারিশ প্রদান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সে আলোকে কর্মসুচি প্রত্যাহার করে সকল পুলিশ।
পুলিশ সদস্যরা যে ১১ দফা দাবি জানিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, চলমান ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যাসহ সকল পুলিশি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত বিচারের আওতায় আনা, নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান আজীবন পেনশন রেশন প্রাপ্তি এবং পরিবারের একজন সদস্যের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করা। আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা এবং গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা; পুলিশের নিয়োগ বিধিমালা বিশেষত সাব ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট নিয়োগ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অধীনে কনস্টেবল নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। সাব ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট পদে বিদ্যমান পদোন্নতিসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা। সেক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক পদ থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে ৩০ শতাংশ সরাসরি এবং ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ এবং সেটি যথাসময়ে নিশ্চিত করা। সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট থেকে ইন্সপেক্টর পদে পিএল হওয়ার এক বছরের মধ্যে পদোন্নতি দিতে হবে। এ ছাড়া কনস্টেবল, নায়েক, এটিএসআই, এএসআই পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষায় পাসকৃতদের পরবর্তী বছর পুনঃপরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা বাতিল এবং পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে পাসকৃতদের সিনিয়রিটি অনুসরণ করা; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পুলিশের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টা করা এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য ওভারটাইম প্রদানের ব্যবস্থা করা অথবা বছরের দুটি বেসিকের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করা; পুলিশের ঝুঁকি ভাতা বৃদ্ধিকরণ, টিএ-ডিএ বিল প্রতিমাসের দশ তারিখের মধ্যে প্রদান এবং প্রযোজ্য সকল সেক্টরে সোর্স মানি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে, পুলিশ সদস্যদের বাৎসরিক ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি বৃদ্ধি করে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ৬০ দিন করতে হবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে ছুটি ছাড়া সম্ভব না হলে অভোগকৃত ছুটির বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা; পুলিশ বাহিনীর প্রচলিত পুলিশ আইন এবং পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল সংস্কার করে যুগোপযোগী এবং কার্যকরী করতে হবে। যার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা এবং অধস্তন কর্মকর্তার কর্মচারীদের অধিকার নিশ্চিত হয়। পুলিশ বাহিনীকে যেন কোনও দলীয় সরকার তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। পুলিশের সকল থানা, ফাঁড়ি এবং ট্রাফিক বক্স আধুনিকায়ন করতে হবে এবং অধস্তন অফিসারদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল ব্যারাকে বিদ্যমান আবাসনসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে ব্যারাকগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে।