সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শবে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা আবদুর রহমান
ইসলামে পাঁচটি রাতকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম পবিত্র শবে মেরাজ। এই রাতে রাসুলের (সা.) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি ‘মেরাজ’ সংঘটিত হয়। ২৬ রজব দিবাগত রাতে রাসুল (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। ঐতিহাসিক সেই সফরকেই মেরাজ বলা হয়।
মেরাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা, সোপান ইত্যাদি। রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদে হারাম থেকে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করার নামই মেরাজ। কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি বান্দাকে তার নিদর্শনগুলো দেখানোর জন্য রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)
নবুয়তের দশম বছরে আল্লাহর নবীর (সা.) ৫০ বছর বয়সে মেরাজের অলৌকিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, মেরাজের রাতে রাসুল (সা.) উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ হজরত জিবরাইল (আ.) এসে রাসুলকে মসজিদে হারামে নিয়ে যান, যেখানে তার বুক বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে সিনা ধুয়ে পরিষ্কার ও শক্তিশালী করা হয়। এ ঘটনাকে ‘শাক্কুস সদর’ বলে।
নবীজির (সা.) জীবনে অন্তত তিনবার এমনটা হয়েছে। তারপর সেখান থেকে তিনি ‘বোরাক’ নামক এক ঐশী বাহনে চড়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে এসে সব নবীর ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বোরাকে চড়ে ঊর্ধ্বে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করেন। রাস্তায় হজরত মুসা (আ.)-সহ বেশ কয়েকজন নবী-রাসুলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। সপ্তম আসমানের পর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বায়তুল মামুর পরিদর্শন করানো হয়। সেখানে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন।
বায়তুল মামুরে হজরত জিবরাইলকে (আ.) রেখে তিনি ‘রফরফ’ নামক আরেকটি আসমানি বাহনে চড়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, মেরাজের রাতে রাসুল (সা.) আল্লাহ তায়ালার এতটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন যে, দুজনের মধ্যখানে মাত্র এক ধনুক পরিমাণ ব্যবধান ছিল। এখানে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতে মোহাম্মদির ওপর ফরজ করেন, যা ইসলামের পাঁচটি রোকনের অন্যতম রোকন বা ভিত্তি। যেহেতু মেরাজের রাতে নামাজের নির্দেশ হয়েছে, এজন্য নামাজকে ‘মেরাজুল মুমিনিন’ বা মুমিনের মেরাজ বলা হয়।
শবে মেরাজ উম্মতে মোহাম্মদির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার। নবীজি (সা.) আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর উছিলায় আল্লাহ তায়ালা মহাজগতে অনেক আয়োজন করেছেন। তাই এমন একজন প্রিয় ব্যক্তিকে বিশেষ অভ্যর্থনার মাধ্যমে কাছে ডেকে নিয়েছেন। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধুকে নিজের কাছে বিশেষ দাওয়াতের মাধ্যমে পার্থিব জগৎ ছেড়ে ঊর্ধ্বজগতে নেওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে একটি আশ্চর্য ঘটনা উপহার দিয়েছেন। সে সময় রকেট, বিমান বা বর্তমান আধুনিক কোনো মাধ্যম ছাড়া খুব অল্প সময়ে এতকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম, সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন ফেরেশতার মাধ্যমে। সহিহ বুখারির ৩৮৮৭ নং হাদিসের মেরাজের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে।
মেরাজের ঘটনাকে অলীক কিংবা কাল্পনিক অথবা জাদুবিদ্যার বহিঃপ্রকাশ বলার কোনো সুযোগ নেই। মেরাজের ঘটনা পুরোটাই ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে বিশেষ ফজিলত মনে করে মনগড়া কোনো আমল বা রুসুম-রেওয়াজ পালনেরও সুযোগ নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশে প্রচলিত মেরাজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিছিল-সমাবেশ, র‌্যালি, মেরাজের বিশেষ বাহন বোরাকের আকৃতিতে কোনো জন্তু বানিয়ে শোডাউন করা গর্হিত কাজ। এসব অনর্থক কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখে মেরাজের আসল তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করা। এছাড়াও শিরক না করা, পিতা-মাতার অবাধ্যচরণ না করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা থেকে বিরত থাকা, সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, খাদ্যাভাবে সন্তানকে হত্যা না করা, অহংকার ও অনুমাননির্ভর কাজ থেকে বিরত থাকা, জেনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও না যাওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা আমরা মেরাজের ঘটনা থেকে পাই।
শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের কথা শরিয়তে উল্লেখ করা হয়নি। তবে অন্যান্য দিনের মতোই এ রাতেও নফল ইবাদত করতে কোনো বাধা নেই। মহানবী (সা.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতে রজব মাস থেকেই। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবীজি (সা.)-এর আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’ কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবীজি (সা.) রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন; রমজান মাসে ৩০টি রোজা রাখতেন। (দারিমি)। নফল নামাজ-রোজা যে কোনো রাতে করতে নিষেধ নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই এ রাতের নির্দিষ্ট কোনো আমলের কথা না বলা হলেও কেউ আল্লাহ-প্রেমে রাতের নামাজ-তেলাওয়াতে মশগুল হলে অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হবেন ইনশাআল্লাহ।
সৌজন্যে: দৈনিক সময়ের আলো

সম্পর্কিত পোস্ট