মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রামে পণ্যের বদলে জাহাজভরা মদ

  • দেশকাল২৪.কম

সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দিয়ে চীন থেকে তিন জাহাজভর্তি মদ আমদানির চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ৬৬৯টি বক্সে এক হাজার ৪০৬ টন মেশিনারিজ আনার ঘোষণা দিয়ে মদের এ চালান আনা হয় দেশে। কাস্টমস থেকে নেওয়া সাময়িক অনাপত্তিপত্রে ৬৬৯ বক্স ক্যাপিটাল মেশিনারিজ থাকার কথা উল্লেখ করে জালিয়াতচক্র।

এরই মধ্যে দুটি লাইটারেজ জাহাজে প্রায় ৬০০ বক্স পণ্য খালাস করে নেয় তারা। বন্দর থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে নোঙর করে রাখে তারা এ দুটি জাহাজ। অবশিষ্ট মদ খালাস করতে ঠিক করা হয়েছিল আরেকটি লাইটারেজ জাহাজ। পানামার পতাকাবাহী বড় জাহাজ থেকে এই জাহাজেও ৩৮ বক্স মদের চালান নামানো হয়েছিল। কিন্তু খালাসের এক পর্যায়ে হঠাৎ করে ভেঙে যায় কাঠের তৈরি একটি বক্স। ভাঙা বক্সে মদের বোতল দৃশ্যমান হলে ফাঁস হয়ে যায় চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা।

কাস্টমস কর্মকর্তাদের চোখকে ধুলো দিয়ে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ এ চালান খালাসের শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ায় চলছে তোলপাড়। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দরে সরকারি কোনো প্রকল্পের চালানে এভাবে মদ আমদানির ঘটনা এটিই প্রথম। এত বিপুল পরিমাণ মদ আমদানির ঘটনাও এটি

প্রথম। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের কথা বলে চায়না-বাংলাদেশ পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের জন্য এসব মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করে এসব পণ্য চূড়ান্ত শুল্ক্কায়ন ছাড়াই সাময়িকভাবে লাইটারেজ বার্জে খালাসের অনুমতিও নেয় তারা কাস্টম থেকে। লাইটারেজ বার্জে সব পণ্য খালাসের পর শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে গ্যারান্টিপত্রও দেয় তারা। বিশেষ এ সুবিধা নিয়েই মেশিনারিজের আড়ালে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি কিউ জি শান’ থেকে তিনটি লাইটারেজ জাহাজে বা বার্জে মদের চালান খালাস করা হচ্ছিল।

এ তিনটি লাইটারেজ বার্জের মালিক শফিকুল আলম জুয়েল নামের এক ব্যক্তি। এ চালান খালাসের দায়িত্বে থাকা সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান বিপাসা এন্টারপ্রাইজেরও মালিক তিনি। সিঅ্যান্ডএফ ও লাইটারেজ বার্জের মালিক একই ব্যক্তি হওয়ায় এ ঘটনায় তার যোগসাজশ আছে বলে ধারণা করছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। থাইল্যান্ডে থাকায় শফিকুল আলম জুয়েলের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রামের চৌমুহনীতে জুয়েলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানকার কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। তবে সন্ধ্যায় সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিভিন্ন সংবাদপত্র অফিসেএকটি ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে বিপাসা এন্টারপ্রাইজ।

ক্যাপিটাল মেশিন আমদানিতে শুল্ক্ক দিতে হয় মাত্র এক শতাংশ। মদ আমদানির ওপর ৩৯৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক্ক আরোপ করা আছে। এ জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজের ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা হয়েছে এত বিপুল পরিমাণের মদ। আটক এ চালানে মোট কত শত কোটি টাকার শুল্ক্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে তা এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

৬৬৯ বক্সে কত হাজার মদের বোতল আছে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি সেটিও। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গতকাল বুধবার ঘটনাস্থলে গেছেন কাস্টমস কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যে দুটি জাহাজ এরই মধ্যে পণ্য খালাস করে চলে গেছে সেগুলোকে আটক করে সব বক্স শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। বিশেষ টিম করে ৬৬৯ বক্স চালানের সব পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফ করে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন কাস্টম কমিশনার ফখরুল আলম।

কাস্টম কমিশনার বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মেশিনারিজ আমদানির ঘোষণা দিয়ে মদসহ বিভিন্ন পণ্য আনা হয়েছে। সিঅ্যান্ডএফ বিপাসা এন্টারপ্রাইজ ও সন্দেহভাজন তিনটি বার্জের মালিক শফিকুল আলম জুয়েল নামের একই ব্যক্তি হওয়ায় আমরা এ ব্যাপারে তার যোগসাজশ আছে বলে সন্দেহ করছি।

এখন তিন লাইটারেজ বার্জে থাকা সব পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করব আমরা। এ চালানের মাধ্যমে কত শত কোটি টাকার শুল্ক্ক ফাঁকির চেষ্টা হয়েছে সেটিও নিশ্চিত হওয়া যাবে পরীক্ষার পর।’ বন্দর জেটিতে থাকা কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা পণ্য অগ্রাধিকার সুবিধা পায়। বড় জাহাজে প্রতিদিনকার খরচ বেশি হওয়ায় আমরা সর্বোচ্চ ২০ দিনের সময়সীমা দিয়ে এ ধরনের পণ্যকে লাইটারেজ জাহাজে রাখার সাময়িক অনুমতি দিই।

শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ করে পরবর্তী সময়ে দেওয়া হয় তাদের চূড়ান্ত ছাড়পত্র। বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ২০ দিন লাইটারেজ জাহাজে থাকা পণ্য কাস্টমসের তত্ত্বাবধানে থাকে। জেটিতে থাকা লাইটারেজ বার্জের পাশাপাশি যে দুটি লাইটারেজ বার্জ সন্দেহভাজন পণ্য খালাস করে অন্যত্র অবস্থান করছে, সেগুলোও আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এসব জাহাজের সব পণ্য জেটিতে খালাস করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি আমরা।

‘বড় জাহাজ থেকে লাইটারেজ বার্জে পণ্য খালাসের সময় কাস্টমসের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা ছিলেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’ হঠাৎ করে কার্টন ভেঙে পড়ায় মদ আমদানির বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই এ চালান আটক করা হয়েছে।’ তবে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কার্টন ভেঙে মদ বের হয়ে যাওয়ার পর বন্দরের ওয়াচম্যানের নজরে আসে বিষয়টি। তখন আর এটি ধামাচাপা দিতে পারেনি কেউ।’

নথি গেটে জানা গেছে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মেশিনারিজ আমদানির কথা বলে এ চালানের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে বিশেষ সুবিধা নেওয়া হয় ৭ জুলাই। কাস্টমসের সহকারী কমিশনার হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি পত্রে উল্লেখ করা হয়, দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ৭৮ ধারা অনুযায়ী ৬৬৯ বক্সে থাকা এক হাজার ৪০৬ টন পণ্য বিশেষ সুবিধায় তিনটি লাইটারেজ বার্জে সাময়িকভাবে স্থানান্তর করা যাবে। এমভি সি স্কাই-৫, এমভি এএমএমএস লজিস্টিকস-৪ ও ডিবি সি এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি জাহাজে এসব পণ্য ২০ কার্য দিবসের জন্য খালাস করতে বলা হয়। চূড়ান্ত শুল্ক্কায়নের পর এসব পণ্যের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে এ চিঠিতে উল্লেখ আছে। বিশেষ এ সুবিধা পাওয়ায় প্রথম দুটি লাইটারেজ বার্জে প্রায় ৬০০ বক্স পণ্য এরই মধ্যে খালাস করে নিয়ে যায় বিপাসা এন্টারপ্রাইজ। ডিবি সি এন্টারপ্রাইজ নামের জাহাজে ৩৮ বক্স পণ্য নামানোর পর মঙ্গলবার রাতে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। এখনও পানামার পতাকাবাহী জাহাজে ৩০ থেকে ৪০ বক্স পণ্য রয়ে গেছে।

‘এমভি কিউ জি শান’ নামের জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে নোঙর করে ১৮ জুলাই। এ জাহাজে ৪৬টি প্রতিষ্ঠানের মোট ১১ হাজার ৫১১ টন পণ্য রয়েছে। পাঁচ হাজার ৯১৬টি প্যাকেজে এসব পণ্য আমদানির ঘোষণা আছে কাস্টম হাউসে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬৬৯ বক্সে এক হাজার ৪০৬ টন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসার ঘোষণা ছিল।

গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পানামার পতাকাবাহী বড় জাহাজের সঙ্গে আছে একটি লাইটারেজ বার্জ। এ বার্জে আছে কাঠের কয়েকটি বক্স। তিনটি বক্স ভাঙা অবস্থায় দেখা যায়। লাইটারেজ বার্জটি যাতে পালাতে না পারে সে জন্য বন্দরের একটি টাগবোটও আছে এটির সঙ্গে। এমভি কিউ জি শান জাহাজ থেকে তখন অন্য আমদানিকারকদের পণ্য নামানো হচ্ছিল। জাহাজে থাকা ক্রুরা জানান, মেশিনারিজের ঘোষণা থাকা আরও কিছু চালান এখনও বড় জাহাজে রয়েছে। বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের পর এগুলো খালাস করবে তারা।

বিপাসা এন্টারপ্রাইজের বক্তব্য: বিপাসা এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল আলম জুয়েলের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও গতকাল রাতে গণমাধ্যম অফিসে একটি ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে তারা। এতে মেশিনারিজের আড়ালে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আসার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করা হয়। শুল্ক্ আইনের ৭৮ ধারা ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও মেশিনারিজের আড়ালে মাদক, নুডলস কিংবা চীনা খাবার আটকের ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। চূড়ান্ত শুল্ক্কায়ন না হওয়ায় খালাস হওয়া সব পণ্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

সূত্র: দ্য রিপোর্ট২৪.কম

সম্পর্কিত পোস্ট