শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীন শ্রমিকের জীবন

Avatar By apu এপ্রি৩০,২০২১

পেটের দায়ে কাজে গিয়ে এক বছরে জীবন দিয়েছে ৭২৯ শ্রমিক

 

–কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু পরিবহন খাতে ৩৪৮ জন

–কর্মস্থলে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিককে

–কর্মস্থল ও আসা-যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শ্রমিক

–করোনায় গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকরা বেশি চাকরির অনিশ্চয়তায় পড়েছেন

–কোনো শ্রমিক যেন তার সন্তানের কাছে লাশ হয়ে ফিরে না আসে

এসএম আলমগীর

শ্রমজীবী মানুষরা অভাবীই হয়। পেটের দায়ে কেউ কাজ করেন গার্মেন্টসে, কেউ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে, কেউ পরিবহণে, কেউ নির্মাণ শিল্পে, আবার কেউ অন্যান্য শিল্প কলকারখানায়। সন্তানদের মুখে দুবেলা দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে কী হাড়ভাঙ্গা খাটুনি না খাটতে হয়ে তাদের। সামান্য কিছু টাকার জন্য শ্রমিকরা যে শ্রম দিতে যান কর্মস্থলে, সেই কর্মস্থলেই নিরাপত্তাহীন শ্রমিকের জীবন। কারণ অনিরাপদ কর্মস্থলের জন্য কাজ করতে দিয়ে কর্মস্থলেই জীবন দিতে হচ্ছে শত শত শ্রমিককে। তাই মহান মে দিবসের প্রাককালে শ্রমিক নেতাদের চাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কর্মস্থলটা যেন নিরাপদ করা হয়, কর্মরত অবস্থায় মালিকদের অব্যবস্থাপনা বা অবহেলায় যেন আর একজন শ্রমিককেও জীবন দিতে না হয়।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপ তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজারের মতো শ্রমিক মারা যাচ্ছে কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায়। সংস্থাটি ২০২০ সালে যে জরিপ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২০ সালে কর্মস্থলে জীবন দিতে হয়েছে ৭২৯ জন শ্রমিককে। এরমধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে। এছাড়া দিনমজুর ৪৯ জন, বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ জন, মৎস্য ও মৎস্য শ্রমিক ২৭ জন, স্টিল মিল শ্রমিক ১৫ জন, নৌ-পরিবহন শ্রমিক ১৫ জন, মেকানিক ১৪, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ এবং অন্যান্য খাতগুলোতে যেমন ইট ভাটা, হকার, চাতাল, জাহাজ ভাঙ্গা সহ ইত্যাদি সেক্টরে ৬০ জন শ্রমিক নিহত হন।

অবশ্য বিলসের তথ্য মতে ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়, এরমধ্যে ১ হাজার ১৯৩ জন ছিল পুরুষ এবং ৭ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে ৫১৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে কৃষি খাতে ১১৬ জন। সুতরাং সংখ্যাগত দিক থেকে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে।

বিলসের পরিসংখ্যানে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হয়, এরমধ্যে ৩৮৭ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৬৮ জন শ্রমিক আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাতে ৪৯ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৪৮, পরিবহন খাতে ৪৭, জুতা কারখানায় ২০ জন, নৌ পরিবহন খাতে ১৬, তৈরি পোশাক শিল্পে ৩৭, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে ২৯, দিনমজুর ১৬, উৎপাদন শিল্পে ১৯, স্টিল মিলে ১৯, কৃষিতে ১০ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া অন্যান্য খাতে ৪০ জন শ্রমিক আহত হন।

বিগত ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন সেক্টরে ৬৯৫ জন শ্রমিক আহত হন, এদের মধ্যে ৬৭৮ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ১৩২ জন শ্রমিক আহতের ঘটনা ঘটে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক আহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ সেক্টরে ১১৭ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক আহতের ঘটনা পরিবহন খাতে ১০৪ জন।

বিলসের জরিপ তথ্যে আরো উল্লেখ করা হয়, বিগত ১০ বছরে কর্মস্থলে সর্বোচ্চ শ্রমিক মৃত্যু পরিবহন এবং নির্মাণ সেক্টরে। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, পরিবহন সেক্টরে ২০২০ সালে ৩৪৮ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে, যা পুর্ববর্তী দুই বছরের তুলনায় কম। নির্মাণ খাতে ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৪ জন শ্রমিক নিহত হন, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৩৪ জন এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৬১ জন।

কর্মস্থলে শ্রমিকদের শুধু যে জীবন দিতে হচ্ছে তা নয়, কর্মস্থলে শ্রমিকরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, নারী শ্রমিকরা ধর্ষনের শিকার হচ্ছে। জরিপ তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ৫৯৬ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। ৫৯৬ জনের মধ্যে ৩১৬ জন নিহত, ২২৯ জন আহত, ৮ জন নিখোঁজ, ২৪ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, অপহৃত ১৪ জনকে উদ্ধার এবং ৫ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি। এদের মধ্যে ৪৫৪ জন পুরুষ এবং ১৪২ জন নারী শ্রমিক। এদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ২৩২ জন, কর্মক্ষেত্রের বাহিরে ৩৬৪ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। সবচেয়ে বেশি ১০৯ জন শ্রমিক হতাহত হন পরিবহন সেক্টরে, যার মধ্যে ৯০ জন নিহত, ১৩ জন আহত, ৪ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন এবং অপহৃত দুজন শ্রমিককে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ । দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৮ জন শ্রমিক হতাহত হন তৈরি পোশাক শিল্পে। যার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ৩ জন (১ জন নিহত ও ২ জন আহত) এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে বাকি ৭৫ জন নির্যাতিত হন। এরমধ্যে ২৫ জন নিহত, ৪৮ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ, ৩ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি।

গত বছর অভিবাসী খাতে ৬৫ জন শ্রমিক হতাহত হন, এরমধ্যে ৫২ জন নিহত, ১১ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি । নির্মাণ খাতে ৬৩ জন শ্রমিক হতাহত হন, এরমধ্যে ৮ জন নিহত, ৫২ জন আহত এবং ৩ জন শ্রমিক আত্মহত্যা

করেন। কৃষি খাতে ৫৮ জন শ্রমিক হতাহত হন, এরমধ্যে ৪২ জন নিহত, ১১ জন আহত, ১ জন নিখোঁজ, ৩জন আত্মহত্যা এবং ১জন অপহৃত শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়। গৃহশ্রমিক খাতে ৪৪ জন শ্রমিক হতাহত হন, এরমধ্যে ১৬ জন নিহত, ২৩ জন আহত, ৪ জন আত্মহত্যা করে এবং ১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ উল্লেখ করা হয়নি।

কর্মস্থলে নানাভাবে শ্রমিকরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারও একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিলসের জরিপে। গত বছর কর্মস্থলে নির্যাতনে আহত হয়েছেন তৈরি পোশাক শ্রমিক ৪৮ জন, গৃহশ্রমিক ২৩ জন, পরিবহন ১৩ জন,  অভিবাসী শ্রমিক ১১, নিরাপত্তা কর্মী ৬, কৃষি ১১,  নির্মাণ ৫২, মৎস্য এবং মৎস্য শ্রমিক ৯, গণমাধ্যম ১২, অন্যান্য ৪৪ জন। মোট ২২৯ জন শ্রমিক।

তাছাড়া নির্যাতনে মৃত্যুও হয়েছে অনেক শ্রমিকের। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পে ২৫ জন, গৃহশ্রমিক ১৬, পরিবহন ৯০, অভিবাসী শ্রমিক ৫২, নিরাপত্তা কর্মী ১০, কৃষি ৪২, নির্মাণ ৮, দিন মজুর ১১, মৎস্য এবং মৎস্য শ্রমিক ৫, অন্যান্য ৫৭ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ৩১৬ জন শ্রমিকের।

বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ৯৯ জন শ্রমিক আহত হন। আহতদের মধ্যে ৬৪ জন পুরুষ এবং ৩৫ জন নারী শ্রমিক। সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক শিল্পে ৫৪ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া স্পিনিং মিলে ৩১ জন, পাট শিল্পে ১২ এবং চা শিল্পে ২ জন শ্রমিক আহত হন।

জরিপ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৭৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বকেয়া বেতনের দাবিতে। এছাড়া দাবি আদায়ে ১৩৮টি, অধিকার আদায়ে ১১৫টি, বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ৪৫টি, বোনাসের দাবিতে ৩৪টি, লে-অফের কারণে ৩০টি, ভাতার দাবিতে ২৯টি এবং অন্যান্য দাবিতে ২৬টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।

বিগত বছরটি দেশের সবচেয়ে বৃহৎ বেসরকারি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কর্মস্থলে নানা রকম সংকটের পাশাপাশি মহামারি করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হওয়া, বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন রকম সংকটের মুখে পড়ে। ২০২০ সালে মার্চ এর পরবর্তী সময়ে পোশাক কারখানা বন্ধ খোলা এবং পোশাকের অর্ডার স্থগিত ও বাতিল হওয়ার কারণে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখাতের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়ে। অনেকেই বেকারত্বেও মধ্যে পড়েন। আইএলও থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের পোশাক শ্রমিক ও কারখানার ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার আগের তুলনায় পরের মাসগুলোতে বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ পোশাক কারখানা ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত হয় এবং ২০ শতাংশ কারখানা ৩০-৩৯ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন পরিচালনা করে। বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রামের অধীনে থাকা আড়াই শ কারখানার ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৯ জন পোশাক শ্রমিক কাজে যোগ দিতে পারেননি, যা কারখানাগুলোর মোট শ্রমিকের ৪১ শতাংশ ৮ । ফলে বেকার হয়েছেন প্রায় দুই লাখেরও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক।

কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে শ্রমিক নেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়ে মালিকদের অবহেলা এবং অব্যবস্থাপনার জন্য কর্মস্থলে জীবন দিতে হচ্ছে শ্রমিককে। নিরাপদ কর্মস্থল শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। আমাদের দেশের ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই মে দিবসের প্রাককালে আমাদের দাবি প্রতিটি শ্রমিকের প্রতিটি কর্মস্থল হোক নিরাপদ। সন্তানদের কাছ থেকে সকালে বিদায় নিয়ে কাজে গিয়ে কোনো বাবা বা মা যেন সে সন্তানের কাছে লাশ হয়ে ফিরে না আসে-এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

সম্পর্কিত পোস্ট